বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত দুই জঙ্গি সংগঠন জামাতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ-জেএমবি, আনসার আল ইসলাম ও ভারতের জামআতুল মুজাহিদীন ইন্ডিয়া-জেএমআই একজোট হয়েছে। তারা সংগঠিত হচ্ছে ‘গাজওয়াতুল হিন্দ’ বা ‘হিন্দুস্থানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’কে সামনে রেখে। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া চার জঙ্গির কাছ থেকে এ সংক্রান্ত তথ্য পেয়েছে ভারতের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। জঙ্গিবাদ দমনে তথ্য বিনিময়ের মাধ্যমে এ অপতৎপরতা বন্ধে একসঙ্গে কাজ করছে বাংলাদেশ-ভারত গোয়েন্দারা।
বাংলাদেশ-ভারত গোয়েন্দারা কাজ করছে একসঙ্গে
ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট- সিটিটিসির দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই পশ্চিমবঙ্গের ওই চার জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করেছিল কলকাতার স্পেশাল টাস্ক ফোর্স ‘এসটিএফ’।
এ প্রসজ্ঞে ঢাকার পুলিশ কমিশনার শফিকুল ইসলাম গত সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘সম্প্রতি ভারতে বড় মাপের তিন জঙ্গি গ্রেপ্তার হয়েছে। তাদের সম্পর্কে আমাদের কাছে তথ্য ছিল। এ ধরনের তথ্য আমরা আদান-প্রদান করে থাকি। ওই তিনজন জিহাদের জন্য বাংলাদেশ ত্যাগ করেছে। তথ্যটা আমরা জানতাম, যা যথাযথ সময়েই ভারতকে জানিয়েছিলাম।’
সম্প্রতি জঙ্গি তৎপরতা বৃদ্ধি ও জঙ্গিদের সক্ষমতা বেড়েছে জানিয়ে ঢাকার শীর্ষ এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরাও কিন্তু বসে নেই। জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে আমাদের যারা কাজ করছে তারা খুব এক্সপার্ট। ঘটনা ঘটার আগেই আমরা তথ্য পাচ্ছি। যেখানে যতটুকু পাচ্ছি, সেখানেই কাজ করছি।’
যেভাবে খুলছে জঙ্গিদের পরিকল্পনার জট
মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ গতবছরের শেষ দিকে রাজধানী ঢাকার মগবাজার, ইস্কাটন ও রাজাবাজার এলাকায় কয়েকটি সিরিয়াল ডাকাতির ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে জঙ্গি সম্পৃক্ততা পেয়েছিল। এসময় বেশ কয়েকজন জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়। উদ্ধার করা হয় শীর্ষ এক জঙ্গি নেতার মোবাইল ফোন।
সেই মোবাইল ফোন থেকেই ‘গাজওয়াতুল হিন্দ’র জন্য বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের একজোট হয়ে কাজ করা সম্পর্কিত কিছু নথি উদ্ধার হয়। সেসব কাগজপত্রে কীভাবে একজোট হয়ে কাজ করা হবে তা নিয়ে কয়েক পাতার একটি নির্দেশিকা ছিল।
মোবাইল ফোনটি যে শীর্ষ জঙ্গি ব্যবহার করতেন, তার নাম আনোয়ারুল ইসলাম হৃদয়। যাকে ‘হিন্দ অঞ্চল’-এর সামরিক শাখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। পলাতক এই শীর্ষ জঙ্গির সঙ্গে একদিকে যেমন বাংলাদেশের বিভিন্ন কারাগারে থাকা জঙ্গিদের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল, তেমনি তিনি মাঝে-মধ্যেই সীমান্ত পেরিয়ে নিয়মিত ভারতে যাতায়াত করতেন।
পশ্চিমবঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিদের বরাত দিয়ে এসটিএফ বলেছে, বারাসাত থেকে লালু সেন বা রাহুল নামে যাকে তারা গ্রেপ্তার করেছে, গ্রেপ্তারের আগে তার বাসায় এই হৃদয় অবস্থান করেছিল।
রাহুলের বাসা থেকে এসটিএফ হৃদয়ের ব্যবহার করা কয়েকটি ইলেকট্রনিক ডিভাইসও উদ্ধার করেছে। রাহুল অর্থের বিনিময়ে জঙ্গিদের অস্ত্র-বিস্ফোরক সরবরাহ এবং ভারতে সংগঠিত হতে সহযোগিতা করতো।
ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশের একটি মামলার এজাহারভুক্ত আসামি হিসেবে ভারতে গ্রেপ্তার হওয়া রাহুল ও পাভেল ওরফে জোসেফের নামও রয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া রাহুলও অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে নিয়মিত বাংলাদেশে যাতায়াত করতেন। বাংলাদেশের কাকলী মৃধা নামে একজন আইনজীবীকে তিনি বিয়েও করেছেন বলে ঢাকার সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
তবে যোগাযোগ করা হলে বিয়ের কথা অস্বীকার করে কাকলী মৃধা জানান, সাবেক স্বামী শংকর দত্তের সুবাদে রাহুলের সঙ্গে তার পরিচয় ছিল। ২০১৫-১৬ সালে রাহুল তাদের বাড়িতেও এসেছে। রাহুলের সঙ্গে তার সম্পর্কের একটি গুজব উঠেছিল, কিন্তু তারা বিয়ে করেননি।
এদিকে, ভারতে গ্রেপ্তার হওয়া তিন জঙ্গির একজন নাজিউর রহমান ওরফে পাভেল ওরফে জোসেফ বাংলাদেশের আনসার আল ইসলামের শীর্ষ জঙ্গি আল-আমীনের বোন-জামাই।
আল-আমীন কাশিমপুর কারাগারে বন্দি। জেলে থাকা আল-আমীনের সঙ্গে পলাতক শীর্ষ জঙ্গি হৃদয়ের অনেকগুলো কথপোকথনের রেকর্ড পেয়েছে ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশ।
আল-আমীন জানান, তিনি আনসার আল ইসলামের সক্রিয় সদস্য। আগেও একবার আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে গিয়েছিলেন।
জামিনে ছাড়া পাওয়ার পর খুলনার বাসিন্দা আল-আমীন গোপালগঞ্জে গিয়ে অবস্থান করেন। কয়েক মাস পর আবারও তাকে র্যাব গ্রেপ্তার করে। বাংলাদেশে জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ ও আনসার আল-ইসলামের সঙ্গে একজোট হয়ে গাজওয়াতুল হিন্দের জন্য কাজ করার কথা স্বীকার করেন তিনি।
গাজওয়াতুল হিন্দ কী?
গাজওয়াতুল হিন্দ হল ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর একটি ভবিষ্যদ্বাণী। যাতে বলা হয়েছে, হিন্দুস্থানে (ভারতীয় উপমহাদেশ) অমুসলিমদের সঙ্গে মুসলিমদের একটি যুদ্ধ হবে এবং সেই যুদ্ধে মুসলমানরা বিজয় লাভ করবেন।
যদিও বিষয়টি নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। অনেক ধর্মবিদ ও ইতিহাসবেত্তা মনে করেন এই যুদ্ধ ইতোমধ্যে সংগঠিত হয়েছে। কিন্তু গাজওয়াতুল হিন্দ-এর মতবাদকে সামনে রেখেই সংগঠিত হচ্ছে বাংলাদেশ ও ভারতের জঙ্গিরা।
সিটিটিসির একজন কর্মকর্তা বলছেন, বাংলাদেশের নিষিদ্ধ তিন জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম, জেএমবি ও হরকাতুল জিহাদ বা হুজি মূলত আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার অনুসারী। আল-কায়েদা ভারতীয় উপমহাদেশে শাখা ঘোষণার (একিউআইএস বা আল কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট) পর থেকেই তারা একজোট হয়ে কাজ করার চেষ্টা করছিল।
সিটিটিসির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার রহমত উল্লাহ চৌধুরী বলছেন, ‘জঙ্গিরা এখন স্লিপার সেল পদ্ধতিতে সংগঠিত হচ্ছে। একটি স্লিপার সেলের সদস্যরা আরেকটি স্লিপার সেলের তথ্য জানে না। শীর্ষ নেতারা সরাসরি স্লিপার সেলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ও নির্দেশনা দিয়ে থাকে। রেজাউলের কাছ থেকে আমরা সালাউদ্দিন সালেহীনের বিষয়ে কিছু তথ্য পেয়েছিলাম। তাকে গ্রেপ্তারের জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’
ডাকাতি করে কোটি টাকার তহবিল গঠনের চেষ্টা
কোটি টাকার তহবিল গঠনের চেষ্টা করছে জঙ্গিরা। গাজওয়াতুল হিন্দকে সামনে রেখেই এই তহবিল গঠনের চেষ্টা; এজন্য করছে ডাকাতি। ঢাকার অন্তত ছয়টি ডাকাতির ঘটনায় জঙ্গি সম্পৃক্ততা পেয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
ভারতেও তারা স্বর্ণের দোকান, বাসা-বাড়ি ও ব্যাংকে ডাকাতির পরিকল্পনা করেছিল। এজন্য বাংলাদেশ থেকে অন্তত ১৫ থেকে ২০ জন ভারতে গিয়েছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে পশ্চিমবঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া তিন জঙ্গি।
বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের জঙ্গিরা ভারতে গিয়ে সংগঠনের কাজ করছে। ভারতে এখন তাদের প্রচুর জঙ্গি সদস্য তৈরি হয়েছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে।
এ ছাড়া পেশাদার অপরাধী চক্রের সঙ্গে মিশেও ডাকাতি করছে তারা। এতে যে অর্থ আসে, তা পাঁচ ভাগ করে দুই ভাগ সংগঠনের তহবিলে এবং তিন ভাগ সদস্যরা নিজেরা খরচ করে।
কাশ্মীরের সঙ্গে সংযুক্ততা
সূত্র মতে, ভারতের স্পর্শকাতর অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত কাশ্মীরে গিয়ে জঙ্গিবাদের সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন আনোয়ারুল ইসলাম হৃদয়।
তার ফোন থেকে পাওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, সংগঠনের এক শীর্ষ নেতাকে নিয়ে হৃদয় কাশ্মিরে বেশ কয়েক মাস ছিল বলে এক আলাপচারিতায় উঠে এসেছে। এনক্রিপ্টেট অ্যাপ দিয়ে তারা যোগাযোগ করলেও ফরেনসিক পরীক্ষায় কিছু আলাপচারিতা উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল।
হৃদয়কে সঙ্গে নিয়ে কাশ্মিরে যাওয়া ওই শীর্ষ জঙ্গি নেতা জামআতুল মুজাহিদীনের আমীর সালাউদ্দিন সালেহীন বলে ধারণা করছেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা।
২০১৪ সালে ময়মনসিংহে প্রিজনভ্যানে হামলা চালিয়ে সালাউদ্দিন সালেহীনকে ছিনিয়ে নেওয়ার পর থেকেই তিনি ভারতে আত্মগোপন করে আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গত এপ্রিলে ঢাকায় গ্রেপ্তার হওয়া জেএমবির ভারপ্রাপ্ত আমীর রেজাউল হক রেজা ওরফে তানভীর মাহমুদ শিহাবও জিজ্ঞাসাবাদে সালাউদ্দিন সালেহীন ভারতে আত্মগোপন করে আছেন বলে জানিয়েছেন। রেজাউল জঙ্গি সংগঠনটির দাওয়াহ শাখা ও বায়তুল মালের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/২২৪৩
আপনার মতামত জানানঃ