রুশ সরকার তালিবানকে আলোচনার জন্য মস্কোতে আমন্ত্রণ জানালে সেখানে হুঁশিয়ারি দিয়ে তালিবান মুখপাত্র জানিয়ে দিয়েছেন আফগানিস্তানে ঘাঁটি গেড়ে অন্য কোনো গোষ্ঠীকে প্রতিবেশী দেশে হামলা চালাতে দেয়া হবে না। একই সাথে আফগানিস্তানের ৮৫ শতাংশ এলাকা নিজেদের দখলে এসেছে বলে দাবি জানান তালিবান। যদিও এর সত্যতা যাচাই এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের পরোক্ষভাবে পরাজয় স্বীকার তালিবানদের অবস্থানকে আরও জোরদার করে দিলো।
৮৫ শতাংশ দখল নিল তালিবানরা
আফগানিস্তানের ৮৫ শতাংশ এলাকা নিজেদের দখলে এসেছে বলে দাবি করেছে দেশটির কট্টরপন্থি ইসলামিগোষ্ঠী তালিবান। আজ শুক্রবার রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে সফররত তালিবান দলের মুখপাত্র শাহাবুদ্দিন দেলোয়ার ফ্রান্সের বার্তাসংস্থা এএফপির কাছে এই দাবি করেন
শাহবুদ্দিন দেলোয়ার জানান, দেশের বিভিন্ন সীমান্তবর্তী এলাকাসহ আফগানিস্তানের ৩৯৮টি জেলার মধ্যে ২৫০টিই দখলে আনতে সক্ষম হয়েছে তালিবানগোষ্ঠী।
যদিও তার এই দাবির সত্যতা এই মুহূর্তে যাচাই করা অসম্ভব বলে মনে করছে এএফপি। এর কারণ হিসেবে বার্তাসংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশসমূহ আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার এবং তার অব্যবহিত পর থেকে আফগানিস্তানে তালিবানগোষ্ঠীর উত্থানের ফলে দেশটির ক্ষমতাসীন কেন্দ্রীয় সরকারব্যবস্থায় ‘ব্যাপক বিশৃঙ্খলা’ দেখা দিয়েছে।
ফলে, তালিবানরা সত্যিই আফগানিস্তানের বিপুল অংশের দখল নিতে সক্ষম হয়েছে কি না তা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তবে শুক্রবার আফগানিস্তানের হেরাত প্রদেশের ইরান-আফগানিস্তান সীমান্তবর্তী শহর ইসলাম কালা তালিবান সদস্যরা দখলে নিয়েছে বলে জানা গেছে।
তবে তালিবান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ এএফপিকে এ সম্পর্কে বলেন, ‘ইসলাম কালা এখন সম্পূর্ণ আমাদের নিয়ন্ত্রণে।’
দেশটির সশস্ত্র ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর একাধিক কর্মকর্তাও বিষয়টি নিশ্চিত করে এএফপিকে বলেছেন, ইসলাম কালাকে তালিবান দখলমুক্ত করতে অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।
আফগানিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র তারেক আরিয়ান এ সম্পর্কে বলেন, ‘আফগানিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর সীমান্তরক্ষী বাহিনীর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সদস্য বর্তমানে ইসলাম কালায় উপস্থিত আছেন। শহরটি পুনরুদ্ধারে অভিযান চালানোর জোর প্রস্তুতি চলছে।’
প্রসঙ্গত, দু’মাস আগে আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোভুক্ত দেশসমূহের সব সেনা সদস্যকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। প্রথম দিকে যদিও তিনি বলেছিলেন ২০২১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব সেনাকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে, কিন্তু বৃহস্পতিবার এক ঘোষণায় এই সময়সীমাকে এগিয়ে এনে তিনি বলেছেন, ৩১ আগস্টের মধ্যে আফগানিস্তান থেকে সব সেনা সদস্যদের প্রত্যাহার করা হবে।
বাইডেনের সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণার পর থেকে নতুন উদ্যমে আফগানিস্তান দখলে অভিযান শুরু করে তালিবানগোষ্ঠী। ফলে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে সংঘাত শুরু হয় তাদের।
এর মধ্যে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় সংঘাত হয়েছে গত সপ্তাহে, আফগানিস্তানের বাঘি প্রদেশে। সেই সংঘাতে তালিবান সদস্যদের গুলিবর্ষণের মুখে পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছে সরকারি সশস্ত্র বাহিনী।
সম্প্রতি আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি যদিও দাবি করেছেন, তার সরকার দেশের বর্তমান অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে সক্ষম, তবে তিনি এটি স্বীকার করেছেন যে বাইরে থেকে যেমন মনে হয়, আফগানিস্তানের বাস্তব অবস্থা বর্তমানে তার চেয়ে অনেক বেশি জটিল।
বৃহস্পতিবার কাবুলে এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘আমরা বর্তমানে দেশের সবচেয়ে জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আছি; কিন্তু ন্যায্যতা আমাদের সঙ্গে আছে, ঈশ্বরও আমাদের সঙ্গে আছেন।’
পরাজয়ের স্বীকারোক্তি আমেরিকার
এদিকে, পরোক্ষভাবে আফগান যুদ্ধে আমেরিকার পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত সমর্থন করে বলেছেন, আগামী ৩১ আগস্টের মধ্যে দেশটি থেকে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। যদিও আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের মূল সময়সীমা ছিল ১১ সেপ্টেম্বর।
গত বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউজে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, আফগানিস্তানে সেনা মোতায়েন করে রাখার অর্থ হবে আরও বেশি প্রাণহানি। তাই ভিন্ন কোনও ফলাফল আসার যুক্তিপূর্ণ কারণ পাওয়া না গেলে আমি আর কোনও মার্কিন সেনাকে আফগানিস্তানে পাঠাব না।
বাইডেন ‘ভিন্ন কোনও ফলাফল’ পরিভাষা ব্যবহার করে আনুষ্ঠানিকভাবে একথার স্বীকারোক্তি দিয়েছেন যে, আফগানিস্তানে গত ২০ বছরের মার্কিন সেনা উপস্থিতির ফলাফল শূন্য। মার্কিন বাহিনী ভিয়েতনাম যুদ্ধের মতো আফগান যুদ্ধেও পরাজিত হয়েছে।
এর আগে বৃহস্পতিবার দিনের শুরুতে মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর পেন্টাগন জানায়, এরইমধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান থেকে ৯০% সেনা প্রত্যাহার সম্পন্ন হয়েছে।
আফগানিস্তানের দায়িত্ব আমেরিকার নয়
আফগানিস্তানের দায়িত্ব নিতে হবে সে দেশের নেতাদেরই। সমস্ত নেতার একসঙ্গে আলোচনা করে নতুন আফগানিস্তানের রূপরেখা তৈরি করতে হবে। এমনটাই মনে করেন বাইডেন।
বাইডেনের বক্তব্য, তিনি তালিবানকে বিশ্বাস করেন না। কিন্তু কাবুলের সরকার এবং প্রশাসনকেই তার মোকাবিলা করতে হবে। মার্কিন সাহায্যে তৈরি কাবুলের সরকারের হাতে এখন সে ক্ষমতা আছে বলে তিনি মনে করেন।
বাইডেনের বক্তব্য, এর আগে কোনো দেশ দেশ আফগান নেতাদের এক করতে পারেনি। সকলকে একসঙ্গে বসিয়ে ঐক্যবদ্ধ আফগানিস্তান তৈরি করতে পারেনি।
বাইডেন জানিয়েছেন, তিনি চান না আর একটিও মার্কিন প্রাণ আফগানিস্তানে নষ্ট হোক। বহু মার্কিন পুরুষ এবং নারীর প্রাণ গিয়েছে আফগানিস্তানের যুদ্ধে। আর প্রাণ তিনি যেতে দেবেন না।
আফগানিস্তান ত্যাগ করার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, আমরা আমাদের লক্ষ্যগুলো অর্জন করেছি। এ কারণেই চলে যাচ্ছি। তাছাড়া আমরা সেখানে জাতি গঠন করতে যাইনি। নিজেদের ভবিষ্যত নির্ধারণ এবং কীভাবে দেশ পরিচালনা করতে চায় সে ব্যাপারে আফগান জনগণের সিদ্ধান্ত নেয়ার একক অধিকার রয়েছে।
বাইডেন আরো বলেছেন, আফগানিস্তানের দায়িত্ব নিতে হবে আফগান নেতাদেরই। যুক্তরাষ্ট্র আর সাহায্য করতে পারবে না। তার মতে, আফগানিস্তানের সব নেতাকে একসঙ্গে আলোচনা করে দেশের নতুন রূপরেখা তৈরি করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/২১৩৮
আপনার মতামত জানানঃ