গত ১ জুলাই থেকে সারাদেশে কঠোর লকডাউন। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনার প্রকোপ কমাতে সরকার এই সিদ্ধান্ত নিতে কিছুটা দেরী করে ফেলেছে। কারণ চলমান দুই সপ্তাহের বিধিনিষেধের মধ্যেই বৃহস্পতিবার (৮ জুলাই) পর্যন্ত দেশে এক হাজার ১৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৬৭ হাজার ৬০০ জন। এর বিপরীতে সুস্থ হয়েছেন ৩৫ হাজার ৪৩৩ জন। এ পরিস্থিতিতে বিধিনিষেধেও দেশে এত আক্রান্ত ও মৃত্যু হলে, এই কঠোর লকডাউনের কার্যকরিতা কোথায়, এই নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্যেই দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যু কমতে শুরু করবে।
সাফল্য প্রত্যাশিত মাত্রায় নাও আসতে পারে
সরকারের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন বলেন, আমরা আশা করছি সপ্তাহখানেকের মধ্যে সংক্রমণ কমে যাবে। তবে মৃত্যু কমতে কিছুটা দেরি হতে পারে। গত আট দিনে যতটুকু বিধিনিষেধ কার্যকর হয়েছে সেটার কিছুটা সাফল্য আসবেই।
যে মানুষগুলো আক্রান্ত হয়েছে, তাদের ব্যবস্থাপনা তো সঠিকভাবে হচ্ছে না। তাদের মাধ্যমে পরিবার ও অন্যদের মধ্যে করোনা ছড়াচ্ছে। এক্ষেত্রে জরুরি হচ্ছে, উপযুক্ত মাত্রায় কন্টাক্ট ট্রেসিং, আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইন করা।
সাফল্য প্রত্যাশিত মাত্রায় নাও আসতে পারে জানিয়ে তিনি বলেন, হয়তো প্রত্যাশিত মাত্রায় সাফল্য নাও হতে পারে। কারণ শুধু বিধিনিষেধ কার্যকর করলেই তো হবে না। যে মানুষগুলো আক্রান্ত হয়েছে, তাদের ব্যবস্থাপনা তো সঠিকভাবে হচ্ছে না। তাদের মাধ্যমে পরিবার ও অন্যদের মধ্যে করোনা ছড়াচ্ছে। এক্ষেত্রে জরুরি হচ্ছে, উপযুক্ত মাত্রায় কন্টাক্ট ট্রেসিং, আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টাইন করা।
তবে দেশে করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখীর যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তাতে স্বাস্থ্য অধিদফতর আশঙ্কা করছে, জুলাই মাসের সংক্রমণ জুন ও এপ্রিল মাসকে ছাড়িয়ে যাবে। তারা বলছে, রোগীর সংখ্যা দিন দিন এভাবে বাড়লে সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। এমনকি অক্সিজেন সরবরাহেও চ্যালেঞ্জ দেখা দেবে।
বিশেষজ্ঞের মতামত
এ প্রসঙ্গে যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড ইউনিভার্সিটির সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম বলেন, দেশে এবার যে বিধিনিষেধ পালন হচ্ছে, আমি এখন পর্যন্ত যতগুলো বিধিনিষেধ দেখেছি সবগুলোর চেয়ে বেশি শক্ত। মানুষের কষ্ট হচ্ছে, তারপরও বিধিনিষেধটি বেশ কার্যকরী হচ্ছে। প্রথমত দুই সপ্তাহের বিধিনিষেধ প্রয়োজন।
মেহেদী আকরাম বলেন, এখনও দেশে মৃত্যু ও আক্রান্তের রেকর্ড হচ্ছে। আসলে বিধিনিষেধের পরেও যে উচ্চ সংখ্যক সংক্রমণ ও মৃত্যু দেখছি, তা খুবই স্বাভাবিক। করোনাভাইরাসের ইনকিউবেশন টাইম হচ্ছে ৩-১৪ দিন। অর্থাৎ আজ যারা ভাইরাসের সংস্পর্শে আসবে তাদের ভেতর কোভিডের লক্ষণ প্রকাশ পেতে সময় লাগবে তিন থেকে ১৪ দিন। এরপরই আমরা দেখব দৈনিক সংক্রমণ ধীরে ধীরে কমতে শুরু করছে।
ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট অতিদ্রুত ছড়ায়, তাই সংক্রমণ হয়তো কিছুটা ধীরে ধীরে কমবে। আগামী দুই সপ্তাহ দেশব্যাপী কঠোর বিধিনিষেধ বলবৎ রাখার কোনো বিকল্প নেই। তবে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের হাত থেকে মৃত্যু কমাতে হলে ঢাকার বাইরের আক্রান্ত জেলাগুলোতে অক্সিজেন ও হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানলা সরবরাহ এবং আইসিইউ ব্যবস্থা ২-৩ গুণ বাড়াতে হবে। তৃতীয় ঢেউয়ে ৭৫ শতাংশ মৃত্যুই হচ্ছে ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে। তাই অতিদ্রুত জেলা সদর হাসপাতালগুলোতে কোভিড সাপোর্ট ব্যবস্থা না বাড়ালে মৃত্যুর হার কমানো সম্ভব হবে না।
তিনি বলেন, করোনাভাইরাস একজনের শরীরে প্রবেশের পর ৩ থেকে ১৪ দিন পর্যন্ত থাকতে পারে। এই পূর্ণ সময়টা যদি বিধিনিষেধে কেটে যায়, তাহলে অবশ্যই ১৪ দিন পর আমরা ভালো কিছু দেখতে পারব। সংক্রমণ এবং মৃত্যু দুটোই কমে আসবে। দেখা যাবে, সংক্রমণ যেভাবে বেড়েছিল, সেভাবেই কমতে থাকবে।
তিনি আরও বলেন, অনেকে বলছেন দেশে বিধিনিষেধেও শুরু হলো, মৃত্যুও বেড়ে গেল। কিন্তু বিষয়টি এই নয় যে বিধিনিষেধের কারণে মৃত্যু বেড়েছে। বিধিনিষেধের প্রভাবটা আমরা দেখতে পারবো দুই সপ্তাহ পর থেকে। বিধিনিষেধের সঙ্গে মৃত্যুর সম্পর্ক দেখতে গেলে এই সময়টা অপেক্ষা করতে হবে। এখন যে মৃত্যুগুলো দেখছি, সেগুলো গত ১৪ দিনের বা তার আগের। গত কয়েকদিনে আমাদের এক হাজারের ওপরে মৃত্যু হয়েছে এবং শনাক্তের যে সংখ্যা আমরা দেখেছি, সেটি হয়তো আরও কিছুদিন দেখতে হতে পারে। এর পরেই আমরা বিধিনিষেধের সুফল পেতে শুরু করব।
তিনি বলেন, বিধিনিষেধে আগে কাজ হয়েছে এবং এবারও হবে। যেহেতু ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট অতিদ্রুত ছড়ায়, তাই সংক্রমণ হয়তো কিছুটা ধীরে ধীরে কমবে। আগামী দুই সপ্তাহ দেশব্যাপী কঠোর বিধিনিষেধ বলবৎ রাখার কোনো বিকল্প নেই। তবে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের হাত থেকে মৃত্যু কমাতে হলে ঢাকার বাইরের আক্রান্ত জেলাগুলোতে অক্সিজেন ও হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানলা সরবরাহ এবং আইসিইউ ব্যবস্থা ২-৩ গুণ বাড়াতে হবে। তৃতীয় ঢেউয়ে ৭৫ শতাংশ মৃত্যুই হচ্ছে ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে। তাই অতিদ্রুত জেলা সদর হাসপাতালগুলোতে কোভিড সাপোর্ট ব্যবস্থা না বাড়ালে মৃত্যুর হার কমানো সম্ভব হবে না।
এ বছরের জানুয়ারি মাসে দেশে ২১ হাজার ৬২৯ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। এপ্রিল মাসে সেই সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে ছিল। জুন মাসে শনাক্ত হয় এক লাখ ১২ হাজার ৭১৮ জন। জুলাই মাসে এখন পর্যন্ত মাত্র আট দিনেই ৬৭ হাজার ৬০০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে।
শনাক্তের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা
অধিদফতরের লাইন ডিরেক্টর ও মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, এ বছরের জানুয়ারি মাসে দেশে ২১ হাজার ৬২৯ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। এপ্রিল মাসে সেই সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে ছিল। জুন মাসে শনাক্ত হয় এক লাখ ১২ হাজার ৭১৮ জন। জুলাই মাসে এখন পর্যন্ত মাত্র আট দিনেই ৬৭ হাজার ৬০০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ঊর্ধ্বমুখী এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে পরিসংখ্যান বিবেচনায় নিশ্চিতভাবে বলা যায়, জুলাইয়ে রোগীর সংখ্যা জুন-এপ্রিল মাসকেও ছাড়িয়ে যাবে। প্রতিটি মৃত্যুই আমাদের বেদনার্ত করে। এসব মৃত্যু থেকে যদি আমরা শিক্ষা গ্রহণ না করি তাহলে এই মৃত্যু, এই বেদনা মূল্যহীন ও অর্থহীন হয়ে যাবে।
সর্বশেষ করোনা পরিস্থিতি
বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে পাঠানো করোনাবিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আরও ১৯৯ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা দেশে এক দিনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু। এ পর্যন্ত করোনায় দেশে মোট মৃত্যু হয়েছে ১৫ হাজার ৭৯২ জনের।
গত ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়া ১৯৯ জনের মধ্যে ৬৫ জনই ঢাকার। এছাড়া খুলনায় ৫৫, চট্টগ্রামে ৩৭, রাজশাহীতে ১৫, বরিশালে ৩, সিলেটে ৫, রংপুরে ৯ এবং ময়মনসিংহে ১০ জন মারা গেছেন।
এর আগে, বুধবার (৭ জুলাই) রেকর্ড ২০১ জন মারা যান, যা দেশে একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু। তার আগে গত সোমবার ১৬৪ ও মঙ্গলবার ১৬৩ জন মারা যান। এছাড়া জুলাইয়ের ১ তারিখ থেকে প্রতিদিন ১৩০ জনের বেশি মানুষ করোনায় মারা গেছেন।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪০৫
আপনার মতামত জানানঃ