দেশে মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপ কিছুটা কমার পর আবার বাড়তে শুরু করেছে। এর মধ্যে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে লাগোয়া সীমান্তবর্তী কয়েকটি জেলা করোনার নতুন হটস্পট হয়ে উঠেছে। কিছু কিছু এলাকায় করোনা শনাক্তের হার ৫০ শতাংশ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের কারণে করোনা দ্রুত ছড়াচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে খুলনা বিভাগের ছয়টি জেলার সঙ্গে ভারতের ২৮৪ কিলোমিটার সীমান্ত থাকায় এই বিভাগের বাসিন্দারা করোনাভাইরাসের ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হওয়ার বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। ভারত বর্তমানে দ্রুত সংক্রামক নতুন ভ্যারিয়েন্ট বি.১.৬১৭ এর বিরুদ্ধে লড়াই করছে।
চিকিত্সা পদ্ধতি যথাযথভাবে না মেনেই অনেকে অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে যাচ্ছে এবং ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন এড়াতে অবৈধভাবে দেশে ফিরছে। এ ছাড়াও, ভারতে আটকা পড়া বেশিরভাগ মানুষ যশোরের বেনাপোল ও চুয়াডাঙ্গার দর্শনা হয়ে দেশে ফিরছেন।
হাসপাতালে নেই অক্সিজেন ব্যবস্থা
ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও, যশোরের ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে গুরুতর কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য সেন্ট্রাল অক্সিজেন ব্যবস্থা নেই। হাসপাতালটিতে বর্তমানে ২৬৫টি ছোট ও বড় অক্সিজেন সিলিন্ডার রয়েছে।
প্রতিটি সিলিন্ডার এক ঘণ্টা পর্যন্ত অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. আরিফ আহমেদ। তিনি আরও জানান, কেন্দ্রীয় অক্সিজেন ব্যবস্থা স্থাপনের কাজ চলছে। তবে, অক্সিজেন ট্যাঙ্ক ভারত থেকে এখনো আমদানি করা হয়নি।হাসপাতালটি ন্যূনতম কিছু সুবিধাসহ তিনটি নিবিড় পরিচর্যা ইউনিট (আইসিইউ) চালু করেছে।
খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (খুমেক) পাঁচ কিলোলিটার ক্ষমতা-সম্পন্ন কেন্দ্রীয় অক্সিজেন ব্যবস্থা ছিল, যা সম্প্রতি লিন্ডে বাংলাদেশের সহায়তায় ১০ কিলোলিটারে উন্নীত হয়েছে, খুমেক হাসপাতালের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. বিধান চন্দ্র ঘোষ জানান। তিনি জানান, প্রতিদিন গড়ে এক হাজার ২০০ রোগী ভর্তি থাকা ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট এই হাসপাতালে সুযোগ-সুবিধা অপ্রতুল। সরকার আরও একটি পাঁচ কিলোলিটার ক্ষমতা-সম্পন্ন কেন্দ্রীয় অক্সিজেন ব্যবস্থা সরবরাহ করেছে। এটি স্থাপন হলে বেশিরভাগ চাহিদা পূরণ হবে, ডা. বিধান জানান।
খুলনার স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী আশুতোশ কর্মকার গণমাধ্যমকে জানান, এই লক্ষ্যে ৯৭ লাখ টাকা অনুমোদনের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। খুব শিগগিরই দ্বিতীয় অক্সিজেন ব্যবস্থাপনা স্থাপন কাজ শুরু হবে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে খুমেক হাসপাতালে একটি ২০ শয্যার আইসিইউ ইউনিট ও ১৪টি উচ্চ-প্রবাহের ন্যাজাল ক্যানুলা রয়েছে।
খুলনা বিভাগের পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. রাশিদা সুলতানা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, নতুন কোভিড-১৯ হুমকি মোকাবিলায় খুলনা বিভাগে যথেষ্ট চিকিত্সা সুবিধা রয়েছে। তবে, সংশ্লিষ্ট সিভিল সার্জনদের মতে, শুধু খুলনা, সাতক্ষীরা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা ও নড়াইলে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন ব্যবস্থা রয়েছে।
বিভাগটিতে মোট ৪৯টি আইসিইউ শয্যা ও ৩০৪টি উচ্চ প্রবাহের ন্যাজাল ক্যানুলা রয়েছে, ডা. রাশিদা বলেন।
ঝিনাইদহ, মাগুরা, চুয়াডাঙ্গা, বাগেরহাট ও নড়াইল— এই পাঁচটি জেলাতে আইসিইউ সুবিধা নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট সিভিল সার্জনরা। সীমান্ত বন্ধ হওয়ার পর ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া ও সাতক্ষীরা সীমান্তবর্তী অঞ্চল দিয়ে দেশে প্রবেশের সময় কয়েকজনকে আটক করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) তথ্য অনুসারে, গতকাল পর্যন্ত ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত মোট ৪০ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত প্রায় সবাই রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের, তারা জানান।
স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মতে, তাদের আট জনের সাম্প্রতিক ভারত সফর সম্পর্কিত কোনো রেকর্ড নেই, যা স্থানীয় সংক্রমণেরই ধারণা দেয়। মেডিসিন ও সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রিদওয়ানুর রহমান বলেন, ‘প্রাণঘাতী ভাইরাসের দ্রুত বিস্তার ও মৃত্যুর হার কমাতে আমাদের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।’
‘সংক্রমণ হার ১৫ শতাংশের ওপরে উঠলে সংশ্লিষ্ট জেলায় অবিলম্বে লকডাউন দেওয়া উচিত’, তিনি বলেন। এ ছাড়াও, তিনি বলেন, ভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণের ফলে যেসব জেলা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে, সেসব জেলায় সক্ষমতা ও অক্সিজেন সরবরাহ বাড়াতে হবে।
খুলনার পাইকগাছায় লকডাউন
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে খুলনার পাইকগাছা উপজেলার পৌর এলাকায় সাত দিনের লকডাউন ঘোষণা করেছে স্থানীয় প্রশাসন। ১০ জুন (বৃহস্পতিবার) সকাল ৬টা থেকে ১৬ জুন বুধবার রাত ১২টা পর্যন্ত এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে। পাশাপাশি উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের চারটি গুরুত্বপূর্ণ হাটবাজারও এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকবে।
আজ মঙ্গলবার এক গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে পাইকগাছা উপজেলা প্রশাসন এই সিদ্ধান্তের কথা জানায়। বন্ধ ঘোষিত হাটবাজারগুলো হলো কপিলমুনি হাট, চাঁদখালী হাট, বাঁকা বাজার ও কাটিপাড়া বাজার।
চলতি বছর খুলনা জেলার মধ্যে এটাই প্রথম কোনো উপজেলায় লকডাউন ঘোষণা করা হলো। এর আগে ৪ জুন থেকে মহানগরের তিনটি থানা ও পাশের রূপসা উপজেলায় কঠোর বিধিনিষেধ জারি করা হয়। ১০ জুন বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সাত দিনের ওই বিধিনিষেধ চলবে।
খুলনা সিভিল সার্জনের কাযালয় থেকে জানা গেছে, এ পর্যন্ত পাইকগাছা উপজেলায় ২৫৫ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৭ জন মারা গেছেন। হাসপাতালে ভর্তি ১০ জন। চলতি মাসের ৮ দিনে উপজেলায় ২৪ জনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে।
করোনা শনাক্ত আবার দুই হাজার ছাড়াল
এক মাসের বেশি সময় পর দেশে দৈনিক করোনার সংক্রমণ শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে করোনায় মৃত্যুও। গতকাল সোমবার সকাল আটটা থেকে আজ মঙ্গলবার সকাল আটটা পর্যন্ত করোনাভাইরাসে সংক্রমিত ৪৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় ২ হাজার ৩২২ জনের করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে।
আজ মঙ্গলবার বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
গত ৩০ এপ্রিলের পর এই প্রথম এক দিনে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়েছে। করোনায় একদিনে মৃত্যুও এক মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এর আগে গত ৯ মে আগের ২৪ ঘণ্টায় ৫৬ জনের মৃত্যুর কথা জানানো হয়।
গত ২৪ ঘণ্টায় পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হারও বেড়েছে। এ সময় সবচেয়ে বেশি ৩৪৭ জন রোগী শনাক্ত হয়েছেন ঢাকা মহানগরে। আর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৯৯ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে রাজশাহী জেলায়।
এর আগের ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে সংক্রমিত ৩০ জনের মৃত্যু হয়। আর করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয় ১ হাজার ৯৭০ জনের। এ নিয়ে দেশে এ পর্যন্ত করোনাভাইরাস শনাক্ত মোট রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ১৫ হাজার ২৮২। মোট মৃত্যু হয়েছে ১২ হাজার ৯১৩ জনের। করোনা থেকে সুস্থ হয়েছেন ৭ লাখ ৫৫ হাজার ৩০২ জন।
শেষ ২৪ ঘণ্টায় ১৯ হাজার ১৬৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ১২ শতাংশ। আগের দিন এই হার ছিল ১১ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী, কোনো দেশে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে কি না, তা বোঝার একটি নির্দেশক হলো রোগী শনাক্তের হার। কোনো দেশে টানা দুই সপ্তাহের বেশি সময় পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে ধরা যায়।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/২০২৩
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি।
আপনার মতামত জানানঃ