করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও সরকারের মাধ্যমে বেশ কিছু ত্রাণ সহায়তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে। সরকারি এসব সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে ১৭ শতাংশ দরিদ্র মানুষকে ঘুষ কিংবা অন্যান্য খরচ হিসেবে ব্যয় করতে হয়েছে।
গতকাল ‘করোনা মোকাবিলায় ত্রাণ কর্মসূচি : কতটা কার্যকর ছিল?’ শীর্ষক গবেষণা থেকে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
সিপিডি, অক্সফাম ইন বাংলাদেশ, এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন যৌথভাবে গবেষণা এ ভার্চুয়াল সংলাপটি আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান। সংলাপটি পরিচালনা করেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য।
তিনটি সামাজিক কর্মসূচির ওপর গবেষণাটি করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে- খাদ্য সাহায্য, খাদ্য সাহায্যের জন্য প্রণোদনা ও ২৫০০ টাকা করে ৫০ লাখ দরিদ্র মানুষকে সরকারের নগদ সহায়তা।
গবেষণায় মোট দুই হাজার ৬০০ খানাকে বিবেচনা করা হয়েছে। চলতি বছরে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে সরকারের দেয়া সামাজিক কর্মসূচির ওপর ভিত্তি করে জরিপের কাজ করা হয়। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন ও অক্সফাম ইন বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. দীপঙ্কর দত্ত সংলাপে সূচনা বক্তব্য রাখেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান এতে প্রধান অতিথি হিসেবে যুক্ত ছিলেন। এছাড়া দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি এ বি তাজুল ইসলাম, সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী সংলাপে যুক্ত ছিলেন।
গবেষণা জরিপে দেখা গেছে, অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৭৫ শতাংশই সরকারের সামাজিক কর্মসূচির আওতায় দেওয়া সহায়তা পায়নি। অর্থাৎ করোনা মহামারিতে ২৫ শতাংশ অতিদরিদ্র মানুষ সরকারের দেওয়া সহায়তা পেয়েছে। তবে এর বাইরে অপেক্ষাকৃত সচ্ছল মানুষও সরকারের সামাজিক সহায়তা নিয়েছে। গ্রামীণ অঞ্চলের তুলনায় শহর অঞ্চলে ওই প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন অপেক্ষাকৃত ভালো হয়েছে। সবচেয়ে কম আয়ের মানুষ বিবেচনায় গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ১৮.৯ শতাংশ সরকারের দেওয়া ওই সুবিধা পেয়েছে, যেখানে শহর অঞ্চলে সুবিধা পাওয়া মানুষদের সংখ্যা ৪৩.৩০ শতাংশ। প্রযুক্তিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সুবিধা না থাকার কারণে সাহায্য পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য লক্ষ্য করা গেছে। অনেক ক্ষেত্রে নগদ সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তার ১৭ শতাংশ অনেককে ঘুষ বা অন্যান্য খরচ হিসেবে ব্যয় করতে হয়েছে।
অন্যদিকে করোনা মহামারিতে নতুন করে দরিদ্র হওয়া মানুষদের মধ্যে ৭৭.৩০ শতাংশই সরকারের দেওয়া খাদ্য, খাদ্যের প্রণোদনা কিংবা মোবাইলে দেয়া নগদ সহয়তা- এই তিনটা সাহায্য পাননি। শুধু তাই নয়, নতুন করে দরিদ্র হওয়া মানুষগুলো সরকারে দেয়া ওই কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগও তেমন পাননি।
পূর্ণাঙ্গ ও স্বচ্ছ তালিকা না হওয়ার কারণে অনেক অভিযোগ উঠেছে দাবি করে মোস্তাফিজুর রহমান তার উপস্থাপনায় বলেন, যারা সুবিধা পেয়েছেন, তাদের ৪৪ শতাংশই দাবি করেছেন কর্মসূচিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার যথেষ্ট অভাব ছিল। তালিকা করার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ছিল না। তালিকা কোথাও টানানো হয়নি। কারা সাহায্য পেলেন, কোন ক্যাটাগরিতে দেয়া হলো ইত্যাদি জানানো হয়নি। এ বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে তালিকা করা গেলে বেসরকারি পর্যায়ে যথাযথ সাহায্য পেতে সুবিধা হতো বলে সিপিডি মনে করে।
মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকারের সামাজিক কর্মসূচি পরিচালনার ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার তুলনায় জনসংখ্যা হিসেবে এলাকা ভাগ করে সাহায্য দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে কোনো এলাকায় বেশি দরিদ্র থাকলেও তা বিবেচনায় নিয়ে অধিক গুরুত্ব দেয়ার বিষয়টি আমলে নেয়া হয়নি।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান বলেন, ‘করোনা মোকাবেলায় সরকারের বিভিন্ন ত্রাণ বিতরণ গতবারের চেয়ে ব্যবস্থাপনা ভালো হয়েছে এবং আগের চেয়ে স্বচ্ছতার সঙ্গে বিতরণ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত কোনো অনিয়ম এবং দুর্নীতির সংবাদ আমরা পাইনি। এটুআই এবং আইসিটি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমরা সংযুক্ত হয়ে করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় প্রায় সাত কোটি মানুষের একটি ডাটাবেইস তৈরি করেছিলাম। এবারও ওই তালিকা অনুযায়ী মানবিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে এবার ৩৩৩ এর সার্ভিসটির মাধ্যমেও খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এই সার্ভিসটি চালু থাকার কারণে খাদ্যকষ্টে কাউকে ভুগতে হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘যদিও তালিকা টানিয়ে দেওয়ার কথা ছিল, সেটি সব জায়গায় সম্ভব হয়নি। তার পরও আজকের আলোচনা থেকে যেহেতু পরামর্শ আসছে তালিকার তথ্যগুলো উন্মুক্ত করে দেওয়ার, তাহলে আরো বেশি স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠিত হবে। আমরা আগামীতে এ বিষয়টির ওপর আরো বেশি জোর দেব।’
ডা. মো. এনামুর রহমান বলেন, ‘জেলা প্রশাসকদের কাছে সার্বক্ষণিক অর্থ মজুদ রেখেছি। যাতে তারা যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য অর্থ বরাদ্দ করতে পারেন। আমাদের যে চাহিদা সে অনুযায়ী বিতরণের সামর্থ্য সরকারের নেই। এখনো আমরা উন্নত বিশ্বের মতো হইনি। যার ফলে আমরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করেছি। যারা অতিদরিদ্র, যাদের খাদ্য সহায়তা খুব বেশি দরকার তাদের মাঝে আমরা বিতরণ করেছি।’
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি এ বি তাজুল ইসলাম, এমপি, বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ‘ত্রাণ বিতরণ ও গ্রহণের ক্ষেত্রে সামাজিক মূল্যবোধ সৃষ্টির ওপর গুরুত্ব দেন, যেন সঠিক মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব হয়।
সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ও এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘কভিডের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় সরকারি ও ব্যক্তি সহায়তা প্রদানে উৎসাহ কম রয়েছে। ত্রাণ সঠিক মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে তথ্য প্রচার ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করতে হবে। ত্রাণ বিতরণে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও নজরদারি নিশ্চিত করতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সংবাদমাধ্যম ও সরকারের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮২৯
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ