পদ্মানদীর কোল ঘেঁষে গড়ে উঠা রাজশাহী নগরীর দৃশ্যপট এখন অনেকটাই পরিচ্ছন্ন। তবে নদীর হালচিত্র একাকার হয়ে গেছে দূষণে। নগরের রূপে আধুনিকতার ছোয়া লাগলেও সে রূপের ছিটেফোটাও নেই পদ্মায়। এখন পানি শুকিয়ে জেগেছে বিস্তীর্ণ চর। প্লাস্টিক, পলিথিন, আবর্জনায় দূষিত হচ্ছে এর পরিবেশ। পদ্মা যেন এখন ময়লার ভাগাড় !
রাজশাহী শহর সংলগ্ন পদ্মার পাড়ে প্রতিদিন ভিড় জমে হাজারো মানুষের। শহুরে জীবনের ক্লান্তি দূর করতে এবং বুক ভরে নির্মল বাতাস নিতে মানুষ ছুটে যান পদ্মাপাড়ে। পদ্মাপাড় রাজশাহীর অন্যতম বিনোদনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। পদ্মাপাড়কে বিনোদনের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে উদ্যোগও নিয়েছে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন (রাসিক)।
শহররক্ষা বাঁধজুড়ে বসার বেদি ও বিভিন্ন স্থাপনায় সাজানো হয়েছে রাজশাহীর পদ্মাপাড়। পদ্মাপাড়ে মানুষের এমন সমাগমকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে ছোট-বড় শত শত মুখরোচক খাবারের দোকান। এসব মুখরোচক খাবারের দোকানের বর্জ্য, দর্শনার্থীদের ব্যবহার করা প্লাস্টিক, পলিথিন যথাস্থানে ফেলা বা সংরক্ষণ করা হয় না। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে যেখানে-সেখানে। একসময় এগুলোর জায়গা হয় পদ্মার বুকে। এছাড়াও নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ড্রেনের পানির সঙ্গে বয়ে আসে প্লাস্টিক-পলিথিন। সেগুলোও জমাট বাঁধে পদ্মার পানিতে। এতে করে মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে পদ্মার পরিবেশ।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পদ্মায় যতটুকু পানি অবশিষ্ট রয়েছে সেগুলো কচুরিপানায় ছেয়ে গেছে। কচুরিপানার ফাঁকে ভাসে প্লাস্টিক-পলিথিনের আবর্জনা। আর নদীর পাশে দিয়ে স্তূপ আকারে পড়ে আছে পলিথিন, কাগজ, প্লাস্টিকের আবর্জনা আর মুখরোচক খাবারের উচ্ছিষ্ট।
স্থানীয়রা জানান, নগরের পদ্মা গার্ডেন থেকে শুরু করে আই-বাঁধ পর্যন্ত শহররক্ষা বাঁধের কয়েক কিলোমিটারজুড়ে গড়ে উঠেছে শত দোকান। এগুলোতে ভিড় করে হাজারো মানুষ। সবাই মিলে পরিচ্ছন্নতার নিয়ম করলেও তা মানে না কেউই।
স্থানীয় বাসিন্দা সুমন, রফিক, সবুজ-সহ অনেকেই বলেন, গরমের সময় আমরা বিকেল নদীর পাড়ে বসে বিশ্রাম করি। আবার স্বাস্থ্য সচেতন অনেকে শরীর ভাল রাখার জন্য নিয়মিত নদীর পাড়ে হাঁটাহাঁটি করেন। কিন্তু নদীর পাড়ে এভাবে ময়লা ফেলার কারণে দূর্গন্ধে ভরে উঠেছে চারপাশের পরিবেশ। তাই এদিক দিয়ে মানুষ আর হাঁটতে পারছে না।
স্থানীয় বাসিন্দা জব্বার উদ্দিন বলেন, এক সময় নদীর পানিতে মানুষ গোসল করতেন হরহামেশা এবং অনেকে আবার পানি ফুটিয়ে পান করতেন। এখন পান করা তো দূরের কথা পানি দূষিত হওয়ার ফলে নদীর পানি মানুষের কোন কাজে আসছে না।
পরিবেশবিদরা বলছেন, প্লাস্টিক বা পলিথিন পচনযোগ্য নয়। দীর্ঘদিন অক্ষত অবস্থায় থাকে। বাংলাদেশের আবহাওয়া ও মাটির গুণাগুণের কারণে একটা বীজ মাটিতে দিলেই গাছ হয়ে যায়। অন্যদেশে তা সম্ভব নয়। কিন্তু মাটির নিচে এসব পলিথিনের উপরে গাছ বড় হতে পারে না। মরে যায়। যা পরিবেশের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। আবার প্লাস্টিক দূষণের কারণে মাছসহ নদীর অন্য জীবের অস্তিত্ব সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) পরিবেশ বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, প্লাস্টিক ও পলিথিন ডিগ্রেডেবল না। এটা পানি ও মাটিকে দূষিত করে। এর দূষণ জলচক্র এবং খাদ্য চক্রের ভেতরে প্রবেশ করে। সেখান থেকে মাছের মাধ্যমে আমাদের শরীরে প্রবেশ করছে। ফলে আমরা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়ছি।
তিনি আরো বলেন, পদ্মারপাড়ে দোকানিরা উচ্ছিষ্ট, ময়লাগুলো যত্রতত্র ফেলে রাখে। এতে করে আমাদের পরিবেশটা সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। ফেলে রাখা প্লাস্টিক-পলিথিনগুলো নদীর পানিতে মিশে শুকিয়ে গেলে চাষাবাদের জন্য ক্ষতিকর হবে।
রাসিক জানিয়েছে, পদ্মা নদীতে দূষণরোধে নদী সংলগ্ন এলাকার সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করতে কাজ করছে সিটি কর্পোরেশন। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি নগরীর অডভার্ড মুনসক্গার্ড পার্কে জনসাধারণের অংশগ্রহণে করা হয়েছে সভা। পদ্মা নদী দূষণরোধে নগরবাসীকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন রাসিক মেয়র এ.এইচ.এম খায়রুজ্জামান লিটন। একইসঙ্গে মেয়র নগরীর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও পদ্মাপাড়ের সৌন্দর্য বজায় রাখতে নগরবাসীর সহযোগিতা কামনা করেন।
মহানগরবাসীর উদ্দেশ্যে মেয়র লিটন বলেন, যে কোন ধরণের প্লাস্টিক বর্জ্য নদীর জীব ও বৈচিত্র নষ্ট করে। নির্মাণ সামগ্রী, বর্জ্য সামগ্রী, মাটি, রাবিশ ইত্যাদি নদীতে ফেলবেন না। বাসাবাড়ি ও দোকানের ময়লা আবর্জনা যত্রতত্র না ফেলে আপনার এলাকার ভ্যান চালককে দিন। আমাদের গৌরব ও ঐতিহ্যেও অংশ পদ্মা নদীকে সংরক্ষণের দায়িত্ব আমাদের। আপনাদের সকলের সহযোগিতা একান্ত কাম্য।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এখনি নদী দূষণ আর দখল থামাতে না বাড়লে বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষের জীবনযাপনে এর প্রবল প্রভাব পড়বে। নদীর দূষণরোধে প্রয়োজন জনসাধারণের সচেতনতা বৃদ্ধি। যেন তারা প্লাস্টিক-পলিথিন নদীতে, ড্রেনে না ফেলেন। সেই লক্ষ্য নিয়ে সিটি কর্পোরেশনের কাজ করতে হবে। একদিনেই সবকিছু বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়, ধীরে ধীরে গৃহীত কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে বলে আশা করছেন তারা।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৩৪০
আপনার মতামত জানানঃ