চট্টগ্রামের ‘লাইফ লাইন’খ্যাত পোর্ট কানেকটিং সড়কের দুই পাশের হাজারো ব্যবসায়ীর কান্না থামছে না। বছর বছর ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সড়কটির উন্নয়নকাজ শেষ না হওয়ায় শুধু ব্যবসায়ী নয়, হালিশহরের লাখো মানুষ প্রায় অবরুদ্ধ জীবনযাপন করছেন। সড়কটির দশা করুণ থাকায় অন্য এলাকার মানুষ সাধারণত ওই এলাকায় পা ফেলতে চান না।
চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার ও পণ্যবাহী গাড়ি রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে পরিবহনের জন্য পোর্ট কানেকটিং সড়ক নির্মিত হয়। প্রতিদিন গড়ে ১০–১১ হাজার পণ্যবাহী গাড়ি এই সড়ক দিয়ে বন্দর থেকে সারা দেশে যায় এবং সমপরিমাণ গাড়ি বন্দরে ফিরে আসে। কিন্তু কয়েক বছর ধরে রাস্তাটির করুণ দশা। এ কারণে ঘুর পথে কদমতলী এবং বিকল্প টোল সড়ক দিয়ে বন্দরের আমদানি-রপ্তানি মালামাল পরিবহন হচ্ছে।
পোর্ট কানেকটিং সড়কের (পিসি রোড) সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সড়কের উন্নয়ন কাজ পায় তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার সড়কের কাজ পায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স রানা বিল্ডার্স-সালেহ আহমদ (জেভি)। কিন্তু দেড় বছরের মধ্যে এ কাজ শেষ করার কথা থাকলেও তিন বছরেও শেষ করতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।
অবশ্য কাজ শেষ করতে না পারলেও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) কাছ থেকে ঠিকাদার মঈনউদ্দিন বাঁশি হাতিয়ে নিয়েছেন ৬৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ২৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন করপোরেশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে ঋণের বিপরীতে দায়ী ব্যাংকের অগোচরে। তারপর লাপাত্তা হয়ে গেছেন কাজ বন্ধ করে। এ অবস্থায় চসিক গত ৪ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠানটির কার্যাদেশ বাতিল করেছে।
চট্টগ্রাম নগরের নিমতলা থেকে অলংকার মোড় পর্যন্ত পিসি রোডের দৈর্ঘ্য ৫ দশমিক ৬৫ কিমি.। এর মধ্যে নিমতলা থেকে তাসফিয়া পর্যন্ত ৩ দশমিক ৩৫ কিমি. অংশের উন্নয়নের কাজ পায় মেসার্স রানা বিল্ডার্স এবং সালেহ আহমদ (জেভি)। প্রতিষ্ঠানটির হয়ে কাজ করেছেন ঠিকাদার মঈনউদ্দিন বাঁশি। কাজের মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৯ সালের মে পর্যন্ত। ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০১ কোটি ৪২ লাখ টাকা। পরে তিন দফা সময় বাড়িয়ে ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ ধরা হয়। তারপরও কাজ শেষ হয়নি। বরং লাপাত্তা হয়ে গেছেন ঠিকাদার মঈনউদ্দিন বাঁশি। কিন্তু কাজ শুরুর পরপরই ৯ দফায় করপোরেশন থেকে তিনি বিল তুলে নিয়েছেন ৬০ কোটি ১৩ লাখ ৩ হাজার ৫৫১ টাকা। এর মধ্যে ২৪ কোটি ৯১ লাখ ৯৬ হাজার ৩০৭ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন কার্যাদেশটির বিপরীতে ঋণ নেওয়া ইউসিবিএল ব্যাংকের কুমিল্লা শাখার অগোচরে। ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের মহেশখাল রোডের উন্নয়ন এবং গার্ডার ব্রিজ নির্মাণ প্রকল্পেও কাজ না করে আট কোটি টাকা অগ্রিম হাতিয়ে নিয়েছেন এই ঠিকাদার।
জিম্মাদার ব্যাংকের মাধ্যমে না দিয়ে সরাসরি ঠিকাদারকে বিল দেওয়ায় চসিকের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুদ্দিনের বিরুদ্ধে গত ৩১ জানুয়ারি বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে। তবে মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন জাতীয় এক দৈনিককে বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে অ্যাসাইনমেন্ট ব্যাংককে বিল না দিয়ে সরাসরি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান বরাবর বিল পরিশোধ করেছি।’
চসিকের প্রধান প্রকৌশলী লেফটেন্যান্ট কর্নেল সোহেল আহমেদ ওই দৈনিককে বলেন, ‘গত এক বছরে একবারের জন্যও ঠিকাদারের মুখ দেখিনি। বারবার তাগাদা দিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি কাজ বন্ধ রেখেছেন। প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটিকে কালো তালিকাভুক্তও করা হয়েছে। সড়কটির বাকি কাজ শেষ করতে নতুন করে টেন্ডার আহ্বান করা হবে।’
কাজ শেষ না করে বিল তুলে নেওয়া প্রসঙ্গে প্রধান প্রকৌশলী বলেন, ‘যতটুকু কাজ হয়েছে তা যৌথ পরিমাপের জন্য প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানায় চিঠি দেওয়া হয়েছে। তারা না এলে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে কাজের পরিমাপ করা হবে। কাজের অতিরিক্ত টাকা নিয়ে থাকলে তা আদায় করতে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে একাধিকবার তাগাদা, মেয়রের বারবার পরিদর্শন ও এলাকাবাসীর ক্ষোভের পরেও নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি চট্টগ্রাম নগরের আগ্রাবাদ এক্সেস ও পোর্ট কানেকটিং (পিসি) রোডের নির্মাণকাজ। ২০১৭ সালের ২০ নভেম্বর এসব কাজের উদ্বোধন করেন সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। জাপানের দাতা সংস্থা জাইকার অর্থায়নে এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) ‘সিটি গভর্নেন্স প্রকল্পের’ আওতায় প্রায় দেড় শ কোটি টাকা ব্যয়ে এই দুটি সড়কের উন্নয়নকাজ চলছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। সময়ের তুলনায় কাজের অগ্রগতি কম হওয়ার দায় এলজিইডি, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কেউ নিচ্ছে না। তারা পরস্পরকে দায়ী করে দায় সারছে। প্রকল্প-সংক্রান্ত নথিপত্র অনুযায়ী, নির্মাণকাজে দেরি হওয়ার জন্য তাদের সবার দায় আছে।
নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ না করলে শাস্তির বিধান থাকলেও বাস্তবে তার কোনো উদাহরণ পাওয়া যায় না। নাগরিকদের দুর্ভোগ কমানোর জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো আন্তরিকতা দেখা যায় না। এটা দুর্ভাগ্যজনক। একইসাথে উদ্ভব সমস্যা সমাধান করে শীঘ্রই নির্মাণ কাজ শেষ করে লোকজনের ভোগান্তি দূর করার আহ্বান জানান তারা।
এসডব্লিউ/ডিএস/কেএইচ/১৭৪২
আপনার মতামত জানানঃ