
পরীক্ষাগারে তৈরি ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক—শুনতে যেন কোনো সায়েন্স ফিকশন সিনেমার গল্প। কিন্তু না, এটি এখন বাস্তব গবেষণার অংশ। পৃথিবীর কিছু বিজ্ঞানী সত্যিই মানুষের কোষ থেকে তৈরি ছোট ছোট মস্তিষ্ক ব্যবহার করে নতুন ধরণের কম্পিউটার বানানোর চেষ্টা করছেন। এই কম্পিউটারকে বলা হচ্ছে ‘বায়োকম্পিউটার’, আর এর প্রযুক্তিকে বলা হচ্ছে ‘বায়োকম্পিউটিং’।
সুইজারল্যান্ডের একদল গবেষক এই গবেষণায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁরা এমন এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছেন, যেখানে ডেটা সেন্টারগুলোতে থাকবে জীবন্ত সার্ভার। অর্থাৎ, এমন সার্ভার যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো শিখতে পারবে, কিন্তু আজকের কম্পিউটারগুলোর তুলনায় অনেক কম শক্তি ব্যবহার করবে।
প্রচলিত কম্পিউটার দুটি ভাগে বিভক্ত—হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার। কিন্তু বায়োকম্পিউটারের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা একটি নতুন শব্দ ব্যবহার করেছেন—‘ওয়েটওয়্যার’। এই শব্দটি এসেছে ল্যাবে তৈরি অর্গানয়েড বা ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক থেকে। অর্গানয়েড মূলত স্টেম সেল থেকে তৈরি নিউরন বা স্নায়ুকোষ এবং কিছু সহায়ক কোষের গুচ্ছ। এগুলো দেখতে ছোট্ট বলের মতো, কিন্তু এগুলোর কাজ অনেক জটিল। বিজ্ঞানীরা এসব অর্গানয়েডকে ইলেকট্রোডের সঙ্গে যুক্ত করেন। এর পরই শুরু হয় এক আশ্চর্য পরীক্ষা—কীভাবে একটি জীবন্ত কোষগুচ্ছকে মিনি কম্পিউটারের মতো ব্যবহার করা যায়।
ফাইনালস্পার্ক নামের একটি ল্যাবে এই গবেষণা চলছে। এর সহ–প্রতিষ্ঠাতা ড. ফ্রেড জর্ডান বলেন, ‘অনেকের কাছে বিষয়টি অদ্ভুত মনে হতে পারে, কিন্তু বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতে মানুষ এ ধারণা অনেক আগেই শুনেছে। যখন আমরা বলি, একটি নিউরনকে ছোট একটি যন্ত্রের মতো ব্যবহার করব, তখন এটি আমাদের মস্তিষ্ক সম্পর্কে ভাবনার ধরনই বদলে দেয়।’
এই গবেষণায় ব্যবহৃত স্টেম সেলগুলো মানুষের ত্বক থেকে নেওয়া হয়। সুইজারল্যান্ডের গবেষকেরা জাপানের একটি ক্লিনিক থেকে এগুলো কিনেছেন, যদিও দাতাদের পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে। এখন অনেক মানুষ নিজের স্টেম সেল দান করতে আগ্রহী, তবে বিজ্ঞানীরা কেবল সরকারি বা অনুমোদিত উৎস থেকেই সেল সংগ্রহ করেন, কারণ কোষের মান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
স্টেম সেল সংগ্রহের পর শুরু হয় দীর্ঘ প্রক্রিয়া। কয়েক মাসের মধ্যেই এগুলো থেকে তৈরি হয় ছোট ছোট মস্তিষ্কের মতো গঠন—যা বিজ্ঞানীরা ‘মিনি ব্রেইন’ বলে ডাকেন। যদিও এগুলোর জটিলতা মানুষের মস্তিষ্কের মতো নয়, কিন্তু এর গঠন প্রায় একই ধরনের। যখন এই মিনি ব্রেইনগুলো ইলেকট্রোডের সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন এগুলো সরল কী-বোর্ড কমান্ডের প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে। যেমন, গবেষক কোনো বোতাম চাপলে বৈদ্যুতিক সংকেত ওই মিনি ব্রেইনে পৌঁছে যায়। যদি সেটি কাজ করে, তবে কম্পিউটার স্ক্রিনে কিছু কার্যকলাপ দেখা যায়।
এই কার্যকলাপের গ্রাফ অনেকটা ইইজির মতো দেখতে, যা মানুষের মস্তিষ্কের তড়িৎক্রিয়া পরিমাপের যন্ত্র। তবে বিজ্ঞানীরা এখনো পুরোপুরি বুঝতে পারেননি, এই মিনি ব্রেইনগুলো কীভাবে কাজ করছে বা কেন করছে। তাঁদের প্রধান লক্ষ্য হলো এই অর্গানয়েডগুলোকে শেখাতে পারা, যেন এগুলো ধীরে ধীরে নির্দিষ্ট কাজ করতে সক্ষম হয়। এটি হচ্ছে বায়োকম্পিউটার তৈরির প্রথম ধাপ।
তবে এই নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে রয়েছে বড় একটি চ্যালেঞ্জ। সাধারণ কম্পিউটার চালাতে শুধু বিদ্যুৎ দরকার, কিন্তু বায়োকম্পিউটার জীবন্ত কোষ দিয়ে তৈরি—তাহলে এটি কীভাবে টিকে থাকবে? মানুষের মস্তিষ্কে রক্তনালি থাকে, যা পুষ্টি ও অক্সিজেন সরবরাহ করে। কিন্তু অর্গানয়েডে এমন কোনো ব্যবস্থা নেই। এ বিষয়ে ইমপিরিয়াল কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক সাইমন শুল্জ বলেন, ‘আমরা এখনো মস্তিষ্কের মতো রক্তনালি তৈরি করতে পারি না। এটিই আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা।’
ফাইনালস্পার্ক ল্যাব গত চার বছরে কিছু অগ্রগতি অর্জন করেছে। তাঁদের তৈরি অর্গানয়েড এখন চার মাস পর্যন্ত বেঁচে থাকে। তবে মৃত্যুর আগে কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। কখনো কখনো অর্গানয়েড হঠাৎ করে খুব সক্রিয় হয়ে ওঠে, যেন শেষ মুহূর্তে প্রাণপণ চেষ্টা করছে। ড. জর্ডান বলেন, ‘আমরা দেখেছি কিছু অর্গানয়েড মারা যাওয়ার ঠিক আগে প্রচণ্ড সক্রিয় হয়ে যায়। এটি অনেকটা মানুষের মৃত্যুর মুহূর্তে হৃদ্যন্ত্রের হঠাৎ গতিবৃদ্ধির মতো।’ গবেষকরা গত পাঁচ বছরে প্রায় এক থেকে দুই হাজার এমন ঘটনা রেকর্ড করেছেন।
এই গবেষণায় ফাইনালস্পার্ক একা নয়। ২০২২ সালে অস্ট্রেলিয়ার কর্টিক্যাল ল্যাবস ঘোষণা করে, তারা ল্যাবে তৈরি নিউরন দিয়ে একটি সাধারণ ভিডিও গেম ‘পং’ খেলাতে পেরেছে। অর্থাৎ, সেই নিউরন গুচ্ছ ইনপুট চিনতে, প্রতিক্রিয়া দিতে এবং শেখার ক্ষমতা দেখিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরাও মিনি ব্রেইন তৈরি করছেন, তবে তাঁদের লক্ষ্য কিছুটা ভিন্ন। তাঁরা এসব মস্তিষ্ক ব্যবহার করে দেখতে চান, কীভাবে আলঝেইমার বা অটিজমের মতো স্নায়বিক রোগের ওষুধ তৈরি করা যায়। তাঁদের আশা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং বায়োকম্পিউটিং একসঙ্গে কাজ করলে ওষুধ তৈরির প্রক্রিয়া আরও দ্রুত ও কার্যকর হবে।
তবে সব বিজ্ঞানী একমত যে এই প্রযুক্তি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. লেনা স্মিরনোভা বলেন, ‘ওয়েটওয়্যার নিঃসন্দেহে বৈজ্ঞানিকভাবে আকর্ষণীয়, কিন্তু এটি এখনো কম্পিউটার চিপের বিকল্প নয়।’ তাঁর মতে, বায়োকম্পিউটিং কখনোই পুরোপুরি সিলিকন প্রযুক্তিকে প্রতিস্থাপন করতে পারবে না, বরং এটি সহযোগী হিসেবে কাজ করবে। অর্থাৎ, যেখানে জীববিজ্ঞানের জটিলতা বুঝতে হবে বা প্রাণীর ওপর পরীক্ষা কমাতে হবে, সেখানে বায়োকম্পিউটার দারুণভাবে সাহায্য করতে পারবে।
অধ্যাপক শুল্জও একই মত প্রকাশ করেন। তিনি মনে করেন, বায়োকম্পিউটার হয়তো শক্তি সাশ্রয়ী হবে, কিন্তু সাধারণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে সিলিকন চিপের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা সম্ভব নয়। তবে এটি একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্র খুঁজে নিতে পারবে—যেখানে জীবন্ত কোষের শেখার ক্ষমতা দরকার।
বায়োকম্পিউটিংয়ের এই যাত্রা এখনো শুরু মাত্র। কিন্তু এটি মানবজাতির ভাবনার নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে। একসময় যে ধারণা কেবল গল্পে ছিল, এখন তা বাস্তব পরীক্ষাগারে ঘটছে। হয়তো ভবিষ্যতে এমন এক পৃথিবী দেখা যাবে, যেখানে কম্পিউটার শুধু যন্ত্র নয়, জীবন্ত সত্তার মতো শেখে, ভাবে এবং প্রতিক্রিয়া জানায়।
মানুষের মস্তিষ্কই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে উন্নত প্রক্রিয়াকরণ যন্ত্র। বিজ্ঞানীরা যদি এর কার্যপ্রণালীকে প্রযুক্তিতে রূপ দিতে পারেন, তাহলে কম্পিউটিং জগতে ঘটবে এক বিপ্লব। তবে সেই পথে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এখনো রয়ে গেছে—একটি জীবন্ত কম্পিউটার কি টিকে থাকতে পারবে, নাকি প্রযুক্তি আর জীবনের এই মেলবন্ধন একসময় নিজেই নিজের সীমায় থেমে যাবে?
তবু একথা নিশ্চিত, বিজ্ঞানীদের এই প্রয়াস আমাদের চিন্তার পরিধি অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত করছে। হয়তো একদিন সত্যিই আমরা দেখতে পাব, কম্পিউটারের পর্দার ওপারে বসে কাজ করছে এক জীবন্ত মস্তিষ্ক—যা মানুষের তৈরি, কিন্তু নিজেই শেখে, নিজেই বোঝে। বিজ্ঞান এখন সেই স্বপ্নের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে।
আপনার মতামত জানানঃ