ঢাকার শেরেবাংলা নগরের জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালটি বাংলাদেশের একমাত্র সরকারি আধুনিক চক্ষু হাসপাতাল। উন্নত যন্ত্রপাতি ও দক্ষ চিকিৎসক-নার্সদের নিয়ে গড়ে উঠা এই প্রতিষ্ঠানটি দেশের লক্ষাধিক মানুষের চোখের চিকিৎসায় ভরসার জায়গা ছিল। কিন্তু সেই হাসপাতাল গত ১৩ দিন ধরে কার্যত চিকিৎসাসেবা বন্ধ রেখেছে। যেখানে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ হাজার রোগী চিকিৎসা পেতেন, সেই হাসপাতাল এখন একটি অঘোষিত ‘আবাসিক হোটেল’ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এই সংকট শুরু হয় ২৮ মে, যখন ‘জুলাই আন্দোলন’-এর কিছু আহত কর্মী হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীদের ওপর চড়াও হয়ে তাদের তাড়িয়ে দেন। অভিযোগ বলছে, এটি ছিল একটি ‘ভুল বোঝাবুঝি’ থেকে সৃষ্ট সংঘর্ষ। কিন্তু এর ফলাফল ভয়াবহ। চিকিৎসক ও কর্মচারীরা নিরাপত্তাহীনতায় হাসপাতাল ত্যাগ করেন। এরপর হাসপাতালের সব ধরনের চিকিৎসাসেবা বন্ধ হয়ে যায়। সেই থেকে প্রতিষ্ঠানটি কার্যত বসে আছে, অথচ সেখানে প্রতিদিন সরকার থেকে সরবরাহ করা খাবার খাচ্ছেন আন্দোলনকারীরা। চিকিৎসার বদলে সেখানে চলছে থাকার আয়োজন।
সরকারের পক্ষ থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার একাধিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থা বিষয়টি মীমাংসার চেষ্টা করেছে। এমনকি একটি উচ্চ পর্যায়ের মেডিকেল বোর্ড গঠন করে আন্দোলনকারীদের চিকিৎসা পর্যালোচনা করা হয়। ৪ জুন বোর্ড আহতদের পরীক্ষা করে বেশিরভাগকেই ছাড়পত্র দেয় এবং তাদের পুনর্বাসনের সুপারিশ করে।
কিন্তু এখানে শুরু হয় আরেক নাটকীয় মোড়। ৫৪ জন আহতের মধ্যে যারা ছাড়পত্র পেয়েছেন, তাদের অনেকে হাসপাতালে থেকেই যেতে চাননি। বরং তারা অভিযোগ করেন, ‘আমরা ঢাকায় থাকব কোথায়?’ এমন প্রশ্ন তুলে তারা তাদের ছাড়পত্রের কাগজ ছিঁড়ে ফেলেন এবং হাসপাতালে থাকার দাবি জানান। এ অবস্থায় চিকিৎসক ও অন্যান্য স্টাফ আবারও হাসপাতাল ত্যাগ করেন।
স্বাস্থ্যখাতের জন্য ভয়ানক বার্তা
এই ঘটনায় বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের জন্য একটি ভয়ানক বার্তা ছড়িয়ে পড়ছে। ৬০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এবং সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি দ্বারা সজ্জিত একটি হাসপাতাল রাজনৈতিক-আন্দোলনকারীদের চাপে চিকিৎসাসেবা বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছে। চিকিৎসকরা আতঙ্কিত, রোগীরা সেবাবঞ্চিত, অথচ আন্দোলনকারীরা সরকারি প্রতিষ্ঠানে বিনামূল্যে থাকা-খাওয়ার সুবিধা নিচ্ছেন।
প্রশ্ন ওঠে, সরকারের এতসব আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনিক কাঠামো থাকা সত্ত্বেও কেন একটি হাসপাতাল পুনরায় নিয়ন্ত্রণে আনতে এত সময় লাগছে? কেন আন্দোলনকারীদের চিকিৎসা শেষে পুনর্বাসনের বিষয়টি আলাদাভাবে পরিকল্পিত হয়নি? সবচেয়ে বড় কথা, একটি হাসপাতাল যদি আশ্রয়কেন্দ্র বা আবাসিক হোটেল হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তবে দেশের সাধারণ মানুষের চিকিৎসার অধিকার কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়?
এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে হতাশাজনক দিক হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর দ্বিধান্বিত ভূমিকা। স্বাস্থ্য সচিব বলছেন, “কাজটা সহজ নয়, আমরা চেষ্টা করছি।” বিশেষ সহকারী বলছেন, “ঈদের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।” সমন্বয়ক বলছেন, “সম্মিলিতভাবে কঠিন সিদ্ধান্তে আসা দরকার।” অথচ এই সময়ের মধ্যেই হাজার হাজার সাধারণ মানুষ চোখের চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, যাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
সরকারের টাকায় পরিচালিত এই প্রতিষ্ঠান জনগণের। এখানে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কিন্তু সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যেন রাজনৈতিক বিবেচনা ও মানবিক আবেগের দোহাই দিয়ে বারবার পিছু হটছে প্রশাসন। এতে একদিকে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের মধ্যে রাষ্ট্রব্যবস্থার ওপর আস্থা কমে যাচ্ছে।
সমাধান কী?
আহতদের পুনর্বাসন ও নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা: সরকারের উচিত আহতদের জন্য বিকল্প আবাসন ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। হাসপাতাল কোনোভাবেই স্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র হতে পারে না।
হাসপাতালের পূর্ণ কার্যক্রম দ্রুত চালু করা: মেডিকেল বোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী ছাড়পত্রপ্রাপ্তদের হাসপাতাল ছাড়তে বাধ্য করতে হবে। প্রয়োজনে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।
আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা: হাসপাতালের চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশি পাহারা ও নজরদারি বাড়াতে হবে।
রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহার রোধে দৃঢ়তা: যারা সরকারি স্থাপনা দখল করে রেখেছেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। না হলে এটি একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে—কীভাবে রাজনৈতিক দাবির আড়ালে রাষ্ট্রীয় সম্পদ জিম্মি করা যায়।
জুলাই আন্দোলনের পটভূমি যাই হোক, চিকিৎসাসেবাকে জিম্মি করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। জাতীয় চক্ষু হাসপাতালের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে এভাবে চিকিৎসাসেবা বন্ধ থাকা দেশের জন্য বিপজ্জনক। এটি একটি সংকেত—রাষ্ট্র যদি এখনই শক্ত অবস্থান না নেয়, তাহলে ভবিষ্যতে আরও অনেক প্রতিষ্ঠান একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে।
রাজনীতি, আন্দোলন, অধিকার—সবই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অংশ। কিন্তু এসবের আড়ালে যদি সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার—চিকিৎসা—হুমকির মুখে পড়ে, তাহলে সেটি কারও কল্যাণে আসে না। সরকারকে এখনই কঠোর সিদ্ধান্তে যেতে হবে, নাহলে ৬০০ কোটি টাকার হাসপাতাল শুধু রোগী নয়, রাষ্ট্রের সক্ষমতার প্রতীক হিসেবেও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠবে।
আপনার মতামত জানানঃ