২০২৫ সালের মে মাসে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক মাত্রায় পৌঁছেছে। হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) এর সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধুমাত্র এই এক মাসেই দেশে ৬০টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, যেখানে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৯ জন এবং আহত হয়েছেন ৩৮১ জন মানুষ। নিহতদের মধ্যে ৫ জন বিএনপির, ৩ জন আওয়ামী লীগের এবং ১ জন জামায়াতের কর্মী বলে জানা গেছে।
এই পরিসংখ্যান দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের অস্থিরতা ও সহিংসতার প্রবণতার স্পষ্ট প্রতিফলন। বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসার প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংঘর্ষের মাত্রা বাড়ছে। এইচআরএসএস জানায়, এসব তথ্য তারা দেশের জাতীয় ও স্থানীয় গণমাধ্যমের খবর এবং তাদের নিজস্ব অনুসন্ধানী ইউনিটের বিশ্লেষণ থেকে সংগ্রহ করেছে।
রাজনৈতিক সহিংসতার পাশাপাশি গণপিটুনির ঘটনাও উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। মে মাসে অন্তত ১০ জন গণপিটুনির শিকার হয়ে মারা গেছেন এবং আহত হয়েছেন ২৫ জনেরও বেশি। সামাজিক অনাস্থা, আইনশৃঙ্খলার দুর্বলতা এবং বিচারপ্রক্রিয়ার প্রতি আস্থাহীনতার কারণেই সাধারণ মানুষ নিজেরাই আইন হাতে তুলে নিচ্ছে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকেরা।
সাংবাদিকদের ওপর নির্যাতন ও হয়রানি প্রাপ্তিসংক্রান্ত তথ্যও উদ্বেগজনক। মে মাসে মোট ৩১টি ঘটনায় ৯১ জন সাংবাদিক নির্যাতন, গ্রেপ্তার ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে ৩৩ জন আহত হয়েছেন, ৭ জনকে হুমকি দেওয়া হয়েছে এবং ৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া ৭টি মামলায় ৪৮ জন সাংবাদিককে আসামি করা হয়েছে। এটি স্পষ্টতই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকার হ্রাসের ইঙ্গিত দেয়।
নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতার চিত্র আরও ভয়াবহ। এইচআরএসএস-এর তথ্য অনুযায়ী, মে মাসে ১৩৬ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৫৫ জন ধর্ষণের শিকার, যাদের মধ্যে ২৫ জনের বয়স ১৮ বছরের নিচে। বিশেষভাবে উদ্বেগজনক হলো যে ১৪ জন নারী ও কন্যাশিশু দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, এবং ধর্ষণের পর ৩ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এই ধরণের ঘটনা শুধু মানবিক বিপর্যয়ই নয়, সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকি।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, সমাজে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা, বিচারহীনতা এবং নিরাপত্তাহীনতা নাগরিকদের মানসিক অবস্থার ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়ছে। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাব, বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, এবং আইনের প্রয়োগে রাজনৈতিক প্রভাব থাকা এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তিকে উৎসাহিত করছে।
এইচআরএসএস তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, সাংবাদিক ও সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে আন্তঃসংলাপ। তারা সরকারকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছে, বিশেষ করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ এবং নারী-শিশুদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে।
সংগঠনটি আরও বলেছে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায়িত্বশীলতা, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ছাড়া মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোকেও বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আরও সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
এই বাস্তবতায়, সরকারের পাশাপাশি নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম এবং আন্তর্জাতিক মহলের সম্মিলিত উদ্যোগেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের বর্তমান প্রবণতা রোধ করা সম্ভব হতে পারে। রাজনৈতিক সহিংসতা, নারী নির্যাতন এবং সাংবাদিক দমনচর্চার বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। নাগরিকদের মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার রক্ষায় একটি কার্যকর, মানবিক ও দায়িত্বশীল রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তোলা ছাড়া এই সংকট থেকে উত্তরণের কোনো পথ নেই।
আপনার মতামত জানানঃ