ইতিহাস, ঐতিহ্য আর প্রভাব-প্রতিপত্তি সবদিক থেকেই জৌলুসপূর্ণ অটোমান সাম্রাজ্য বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল। নিজেদের অনন্য যুদ্ধ কৌশলের কারণে অটোমান শাসকরা প্রায় ৬শ’ বছরের বেশি সময় ধরে এশিয়া ও ইউরোপ মহাদেশের বিস্তৃত অঞ্চল শাসন করেছিল।
অটোমান সুলতানদের পূর্বপুরুষ তুর্কিকরা মধ্য এশিয়ার বাসিন্দা ছিলেন। স্বভাবে অনেকটা যাযাবর প্রকৃতির এই গোষ্ঠী একাদশ শতকের দিকে আর্মেনিয়া ও আনাতোলিয়ার ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করতে থাকেন। সে সময় ওই এলাকা ছিল অন্যতম পরাশক্তি রোম (বাইজেন্টাইন) সাম্রাজ্যের অধীনে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ওই সময়ে সেলজুক রাজবংশ একটি সালতানাত বা রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে। সীমান্ত এলাকায় সেলজুক রাজবংশ হয়ে লড়াই করে জমি বরাদ্দ পেয়েছিলেন অভিবাসন প্রত্যাশী গোত্রপতি কাইর গোত্রের প্রধান এরতুরুল। যা পরবর্তীতে অটোমান বেলিক নামে পরিচিতি পেয়েছে।
বেলিক বলতে মূলত ছোট ছোট গোত্রের অধিপতিদের বুঝানো হতো, যারা একটি গোত্র বা বিশেষ একটি এলাকা শাসন করতেন। সেলজুক রাজবংশের নিয়ম অনুযায়ী, এসব গোত্রের অধিপতিরা প্রয়োজনে সুলতানের পক্ষে যুদ্ধ করতেন। বিনিময়ে সুলতান ওইসব গোত্রের অধিপতিদের বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষার নিশ্চয়তা দিতেন। তবে বেলিকরা নিজেদের রীতিনীতি অনুযায়ী চলতে পারতো।
এদিকে সালতানাত থেকে দূরে হওয়ায় সীমান্ত এলাকার কাইর গোত্র পশ্চিম আনাতোলিয়ায় বসবাসকারী অন্যান্য গোত্রগুলোর সঙ্গে হাত মিলিয়ে একটি সামরিক শক্তি তৈরি করে। অন্যদিকে মোঙ্গলদের হামলায় সেলজুক রাজত্বের অবসান হলে বেলিক বা গোত্রপতিদের হাতে তাদের বিভিন্ন এলাকা ভাগ হয়ে যায়। পরবর্তীতে এসব গোত্রপতিরা কর দেয়ার মাধ্যমে নিজ নিজ এলাকা শাসন করতেন।
পরবর্তী এরতুরুলের মৃত্যুর পর কাইর গোত্রের গোত্রপতি নির্বাচিত হন তার সন্তান ওসমান গাজী বা প্রথম ওসমান। এরপর ১২৯৯ সালে সেলজুক সাম্রাজ্য থেকে উত্তরপশ্চিমে আনাতোলিয়ার দায়িত্ব পান তিনি। প্রথম দিকে সাম্রাজ্যের প্রতি অনুগত থাকলেও সেলজুক সাম্রাজ্যের শেষদিকে স্বাধীনতার ঘোষণা করেন তিনি। ইতিহাসে এসেছে, মোঙ্গল সাম্রাজ্যে বার্ষিক কর না পাঠিয়ে প্রতীকী অর্থে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন ওসমান। এরপর ধীরে ধীরে অটোমান সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন।
পরবর্তীতে ১৩শ’ সাল থেকেই ওসমানের নেতৃত্বাধীন বাহিনী একে একে বিভিন্ন অঞ্চল জয় করতে শুরু করে। তার দলের লোকজনদের ওসমানী নামে ডাকা হতো। ইতিহাসবিদ ক্যারোলিন ফিঙ্কেল ওসমান’স ড্রিম বইয়ে লিখেছেন, ১৩০১ সালে প্রথম বাইজেন্টাইন একটি বাহিনীকে যুদ্ধে পরাজিত করার মধ্যদিয়ে ওসমানের কথা জানা যায়। ওই যুদ্ধক্ষেত্র বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কনস্টান্টিনোপল থেকে দূরে ছিল না।
পরবর্তীতে ওসমান ও তার উত্তরসূরিরা ইউরোপ ছাড়াও এশিয়া ও আফ্রিকার বহু দেশ দখল করেন। বর্তমান সময়ের তুরস্ক, হাঙ্গেরি, গ্রীস, আলবেনিয়া, সার্বিয়া, বুলগেরিয়া, মেসিডোনিয়া, মিশর, জর্ডান, রোমানিয়া, প্যালেস্টাইন, লেবানন, সিরিয়া, ইয়েমেন ছাড়াও সৌদি আরবের কিছু অংশ ও উত্তর আফ্রিকার উপকূলের বড় একটি অংশ ওসমানী সাম্রাজ্যের আওতায় ছিল। সবমিলিয়ে ১৫ শতাব্দীতে সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিতে অটোমানরা জগতের শ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যে পরিণত হয়।
ইতিহাসবিদদের বর্ণনায় পাওয়া যায়, ভারত ও পূর্ব এশিয়া থেকে আসা মসলা ও সিল্ক বাণিজ্যের ওপর আরোপ করা কর মূলত অটোমান সাম্রাজ্যের আয়ের বড় একটি উৎস ছিল। তবে ১৬ শতকের যখন নতুন নতুন দেশ আবিষ্কার হতে থাকে এবং নতুন নৌপথ আবিষ্কার হয় তখন অটোমানদের ওপর নির্ভরশীলতা কমে যায়।
অন্যদিকে সময়ের সঙ্গে পর্তুগাল, স্পেন, ব্রিটেন নৌ শক্তিতে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। একপর্যায়ে বেশ কয়েকটি যুদ্ধে তাদের অনেক এলাকা হাত ছাড়া হয়। এতে অটোমানদের শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন হয় ইউরোপের বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, মলদোভা, সার্বিয়া ও মন্টেনেগ্রো। আবার সময়ের সঙ্গে রাশিয়ার কাছেও অটোমানরা বেশকিছু এলাকা হারায়। সবমিলিয়ে অদক্ষ সুলতানদের ক্ষমতায় আসা ছাড়াও অটোমান শাসকদের জনগণের মতামত উপেক্ষা করাসহ কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ কমে যাওয়ায় সুলতানদের ক্ষমতাও কমতে থাকে।
ফলে ১৮ শতকে অটোমান শাসনের বিরুদ্ধে একাধিক দেশে শুরু হয় বিদ্রোহ। পরবর্তীতে যার সূত্র ধরে মিশর, আর্মেনিয়া, গ্রীস ছাড়াও আরব এলাকায় যুদ্ধ শুরু হয়। এই সময়ে অটোমানদের বিরুদ্ধে আর্মেনিয়া ও গ্রীসে গণহত্যা চালানোর অভিযোগ উঠে।
ইতিহাসবিদদের বর্ণনা অনুযায়ী, বহু জাতি ও গোত্রের শাসন এলাকা ছাড়াও সামরিক শক্তি বৃদ্ধির দিকে বেশি মনযোগী হওয়ায় অশিক্ষা এবং অন্যান্য দেশের ষড়যন্ত্র অটোমানদের পরাজয়ের বড় কারণ ছিল। অন্যদিকে রাশিয়া ও অস্ট্রিয়া বলকান দেশগুলোর বিদ্রোহে সহায়তা করে। এছাড়া ব্রিটেন ও ফ্রান্স মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তরের এলাকা দখলে নিলে অটোমানরা পতনের সন্নিকটে চলে যায়।
পরবর্তীতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের পর ১৯২২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে অটোমানদের পতন ঘটে। চুক্তির মধ্যদিয়ে তৎকালীন অটোমান সুলতান ষষ্ঠ মেহমেদকে পদচ্যুত করা হয়। একপর্যায়ে পরাজয় মেনে নিয়ে ইস্তাম্বুল ত্যাগ করেন তিনি। আর এরপরই আধুনিক তুরস্কের অভ্যুদয় ঘটে।
আপনার মতামত জানানঃ