দ্বিতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই জয়ের পেছনে একটি বড় ভূমিকা ছিল আরব ও মুসলিম ভোটারদের। দোদুল্যমান হিসেবে পরিচিত মিশিগানে প্রতি ১০ জন আরবের ৬ জন হয় ট্রাম্প, নয়তো গ্রিন পার্টির জিল স্টাইনকে ভোট দিয়েছেন। আরব শহর হিসেবে পরিচিত ডিয়ারবর্নে স্টাইন পেয়েছেন ১৮ শতাংশ ভোট, যা ডেমোক্রেটিক প্রার্থী কমলা হ্যারিসের পাওয়া ভোটের অর্ধেক।
আরব-মুসলিমদের বক্তব্য, তাঁরা ডেমোক্রেটিক পার্টিকে শাস্তি দেওয়ার জন্য হয় ট্রাম্প বা জিল স্টাইনের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। জো বাইডেন ও কমলা ফিলিস্তিনের ব্যাপারে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তার কোনোটাই রাখেননি। মুখে এক কথা বলেছেন, কাজে ইসরায়েলকে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে গেছেন গাজায় গণহত্যা চালাতে। সে জন্য বাইডেনের অন্য নাম ‘জেনোসাইড জো’। আরব-আমেরিকানরা বলছেন, তাঁদের বিশ্বাস, ট্রাম্প ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেবেন। মিশিগানে এসে ট্রাম্প নিজে সেই প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছেন।
যাঁরা সেই প্রতিশ্রুতি বিশ্বাস করেন, তাঁরা হয় অতি সরল, নয়তো বোকার স্বর্গে বাস করেন। ফিলিস্তিন প্রশ্নে ট্রাম্পের অবস্থান তাঁর প্রথম প্রশাসন থেকেই স্পষ্ট। তিনি ইসরায়েলকে খুশি করতে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস তেল আবিব থেকে সরিয়ে এনেছেন জেরুজালেমে। ওয়াশিংটনে পিএলও-এর কূটনৈতিক মিশন বন্ধ করে দিয়েছেন। ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের সহায়তাকারী জাতিসংঘ সংস্থার সব মার্কিন অনুদানও তিনি আটকে দেন। সিরিয়ার গোলান হাইটসে ইসরায়েলের অধিগ্রহণ ও পশ্চিম তীরের সব অবৈধ স্থাপনায় তিনি স্বীকৃতি জানান। গাজায় ইসরায়েলি হামলার পর তিনি নেতানিয়াহুকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘কাজটা শেষ করো।’ নির্বাচনের ১০ দিন আগে তিনি নেতানিয়াহুকে ‘তোমার যা ভালো মনে হয়’ করার জন্য উৎসাহ দিয়েছিলেন।
ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফা বিজয় ইসরায়েলকে দারুণ উল্লসিত করেছে। রাস্তায় বিলবোর্ডে লেখা, ‘ট্রাম্প, মেক ইসরায়েল গ্রেট!’ তাঁদের সে বিশ্বাসের প্রতিধ্বনি করে ইসরায়েলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মতরিচ বলেছেন, ট্রাম্পের এই জয়ের অর্থ হলো পশ্চিম তীরকে ইসরায়েলের সঙ্গে সংযুক্ত করার সময় এসেছে। শুধু সংযুক্তি বা এনেক্স নয়, এই অঞ্চলের ওপর ইসরায়েলের সার্বভৌমত্ব পুরোপুরি নিশ্চিত করার সময় এসেছে।
ইসরায়েল যে ফিলিস্তিন নামের জনপদে কোনো আরব রাষ্ট্র মেনে নেবে না, তা নতুন কথা নয়। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের অভিভাবকত্বে অঞ্চলটিকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল, যার ৫৫ শতাংশে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল, অবশিষ্ট ৪৫ শতাংশে আরব রাষ্ট্র ফিলিস্তিন। তখন থেকেই ইসরায়েলের লক্ষ্য পুরো অঞ্চলটিতে একক আধিপত্য নিশ্চিত করা। প্রথমে ১৯৪৮ সালে ও পরে ১৯৬৭ সালে দুটি যুদ্ধের পর ইসরায়েল প্রস্তাবিত আরব রাষ্ট্রের অধিকাংশ জমিই নিজের দখলে নিয়ে আসে। গত ২৫ বছরে ক্রমাগত ইহুদি বসতি স্থাপনের কারণে এখন হাতে রয়েছে যে একরত্তি জমি, সেখানে আর যা–ই হোক, স্বাধীন কোনো রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়।
ইসরায়েল আশা করছে, ট্রাম্পের দ্বিতীয় আগমনের পর এই অঞ্চলের ওপর ইসরায়েলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অর্জিত হবে। শুধু পশ্চিম তীর নয়, ভূমধ্যসাগর–সংলগ্ন গাজা অঞ্চলকেও ইসরায়েলের সঙ্গে পূর্ণ সংযুক্তি চায় ইসরায়েল। এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা গণহত্যা সে লক্ষ্য অর্জনে দ্রুত এগিয়ে চলেছে।
১৯৪৮ সালের যুদ্ধের পর কয়েক লাখ ফিলিস্তিনকে গাজায় ঠেলে পাঠানো হয়েছিল এই বিশ্বাস থেকে যে, খুব দ্রুতই প্রতিবেশী মিসরের সিনাই মরুভূমিতে তাদের পুনর্বাসিত করা সম্ভব হবে। ভেতরে-বাইরের নানা প্রতিরোধের মুখে সে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয়নি। তা ছাড়া ২০০৬ সালে ফিলিস্তিনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের পর গাজার ভূমিকা বদলে যায়। এই নির্বাচনে অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণ ভার চলে আসে হামাসের হাতে, পশ্চিম তীর রয়ে যায় পিএলও নিয়ন্ত্রিত ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের হাতে।
এই দুই দলের পারস্পরিক বিরোধ ব্যবহার করে নেতানিয়াহু সরকার ‘দুই রাষ্ট্র-সমাধানে’র সব চেষ্টা নস্যাৎ করে দেয়। তাঁর যুক্তি ছিল, ‘ফিলিস্তিনিরা নিজেরাই তাদের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক অংশীদারত্ব নিয়ে একমত নয়। আগে তারা ঐকমত্যে আসুক, তখন দেখা যাবে “টু স্টেট” সমাধানের ভবিষ্যৎ।’
এখন আমরা জানি, ইসরায়েলই অর্থ ও সমর্থন জিগিয়ে এই অঞ্চলের ওপর হামাসের নিয়ন্ত্রণ জিইয়ে রেখেছিল। কাতারের মাধ্যমে নিয়মিত অর্থ পাঠানো হতো হামাস প্রশাসনের হাতে। দুই ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের মধ্যে এই অনৈক্য ব্যবহার করেই প্রথম ট্রাম্প প্রশাসন তথাকথিত আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের উদ্যোগ নেয়। এই প্রকল্প সফল হলে ফিলিস্তিন প্রশ্নটি চিরতরে ধামাচাপা দেওয়া যাবে, ট্রাম্প প্রশাসন ও ইসরায়েল এ ব্যাপারে স্থির নিশ্চিত ছিল।
এই আশঙ্কা থেকেই ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ওপর হামাসের হামলা হয়। এর ফলে ফিলিস্তিনের প্রশ্নটি আবার আলোচনায় উঠে আসে বটে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে গাজাকে ধুলায় মিশিয়ে দেওয়ার সুযোগটি নতুন করে হাতে আসে ইসরায়েলের। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট হাতের আঙুল গুনে গুনে দেখিয়েছিলেন, গাজাবাসীর সামনে এখন মাত্র তিনটি পথ খোলা: আত্মসমর্পণ, মৃত্যু অথবা ডুবে মরা। নিজের কথা রেখেছেন যুদ্ধমন্ত্রী। গাজা এখন বিশ্বের বৃহত্তম শ্মশানভূমি।
গাজা অভিযানের ফলে ইসরায়েলের সামনে দুটি সুযোগ এসেছে; একদিকে গাজার ওপর পূর্ণ সামরিক অধিগ্রহণ, অন্যদিকে পশ্চিম তীরকে পুরোপুরি ইসরায়েলের সঙ্গে সংযুক্ত করা। ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে প্রত্যাবর্তনের ফলে উভয় লক্ষ্য অর্জনের সম্ভাবনা আরও উজ্জ্বল হয়েছে। গাজার ব্যাপারে ট্রাম্প তো নেতানিয়াহুকে বলেই দিয়েছেন, ‘তোমার যা মনে হয় করো।’ পশ্চিম তীরের ব্যাপারেও তাঁর অবস্থান পরিষ্কার। ট্রাম্প ক্যাম্পেইনের দ্বিতীয় প্রধান চাঁদা প্রদানকারী ম্যারিয়েন এডেলসন ১৩০ মিলিয়ন ডলারের চেক লেখার আগে তাঁকে দিয়ে এই প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছিলেন, পশ্চিম তীরের পূর্ণ সংযুক্তি প্রকল্পে তিনি কোনো বাধা দেবেন না।
সে কথা মাথায় রেখেই বেজাবেল স্মতরিচ বলেছেন, ‘এখন সে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় এসেছে।’ শুধু পশ্চিম তীর নয়, তিনি সমগ্র ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণ চান। শুধু তাহলেই ‘জর্ডান নদী থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত’ অঞ্চলে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নপূরণ সম্ভব হবে।
ইসরায়েল রাষ্ট্রের জনক ডেভিড বেন-গুরিয়ন ১৯৩৭ সালে বলেছিলেন, পুরো ফিলিস্তিনে আমাদের প্রস্তাবিত ইহুদি রাষ্ট্র গঠন করতে হলে কিছু আরব ফেল্লাহিনকে বহিষ্কার করতে হবে। বাধ্যতামূলক স্থানান্তর সফল হলে এক বিশাল জনপদ আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসবে।
জো বাইডেনের সাহায্যে ইসরায়েল সেই কাজ প্রায় গুছিয়ে এনেছে। অবশিষ্ট কাজটুকু ট্রাম্পের নতুন প্রশাসনের সময়ে অর্জিত হবে, ইসরায়েল সে আশাই করছে।
আপনার মতামত জানানঃ