কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের ব্যাপকহারে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের প্রমাণ মিলেছে খোদ এই বাহিনীর নথিতেই। এই প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের কারণেই ব্যাপক জীবনহানি ও আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। যেসব অস্ত্র নিয়ে গুলি চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তা বেসামরিক মানুষকে উদ্দেশ্য করে ব্যবহার করা হয় না। এসব অস্ত্রের গুলিতে মৃত্যু নির্ঘাত। বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দেড় হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে ত্রিশ হাজারের বেশি।
মানবজমিন অনুসন্ধান চালিয়ে দেখেছে, গত ১৮ই জুলাই থেকে ২১শে জুলাই পর্যন্ত ৪ দিনে ঢাকার অন্তত ৪টি স্পটে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি বিপুল পরিমাণ প্রাণঘাতী মারণাস্ত্র ব্যবহার করে। অধিকাংশই এইম অন ফায়ার লক্ষ্যবস্তু টার্গেট করে গুলি করা হয়। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে পুলিশের করা ঢাকা মহানগর ও চট্টগ্রাম মহানগরীর ২২টি থানার অন্তত ১০০টি মামলার এজাহার পর্যালোচনা করে এই তথ্য মিলেছে। ‘লয়্যার ফর এনার্জি, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানও এসব মামলার নথি পর্যালোচনা করেছে।
মামলার এজাহার ঘেঁটে দেখা গেছে, জুলাই মাসের ১৮ তারিখ থেকে ২১ তারিখ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনী যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, উত্তরা, কদমতলী, রামপুরা, ধানমণ্ডি ও চট্টগ্রাম চাঁদগাঁও এলাকায় ছাত্র আন্দোলন দ্রুত সময়ে দমাতে স্পেশাল পারপার্স অটোমেটিক শটগান (স্পার্স), ৭.৬২ এমএম চায়না রাইফেল, এসএমজি, এলএমজি, বিডি-৮ অ্যাসল্ট রাইফেল, টরাস ৯ এমএম, ৯.১৯ এমএম সিজে পিস্তল থেকে ১৭ হাজার ২৯ রাউন্ড বুলেট ছুড়েছে। এমনকি ১৬টি শক্তিশালী গ্রেনেডও ছোড়া হয়। প্রাণঘাতী অস্ত্র থেকে ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে ১৫৬৩ রাউন্ড, মোহাম্মদপুরে ২৯৮ রাউন্ড ও সিসা বুলেট ২৯৮৪ রাউন্ড, উত্তরায় ৩৯০ রাউন্ড, ধানমণ্ডিতে ৩৩৭ রাউন্ড ও শাহবাগে ৪৩ রাউন্ড বুলেট ছোড়া হয়। মানবজমিন অনুসন্ধানে আন্দোলনে কোন স্পটে পুলিশের কোন সদস্য কতো রাউন্ড গুলি ব্যবহার করেছে এবং কি ধরনের অস্ত্র থেকে এসব গুলি ছোড়া হয়েছে তাও বিস্তারিত জানা গেছে। যার নথিপত্র মানবজমিনের হাতে রয়েছে। নিহতের ঘটনাগুলোয় পুলিশ বাদী হয়ে করা বেশির ভাগ মামলায় বিক্ষোভকালে সন্ত্রাসী বা দুষ্কৃতকারীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে। এবং জানমাল রক্ষায় গুলি চালানো হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এদিকে পুলিশের গুলিতে ১৮ই জুলাই থেকে ২১শে আগস্ট পর্যন্ত ৩৪১ জন নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। মারা যাওয়াদের মধ্যে অধিকাংশই এইম ফায়ার বা লক্ষ্যবস্তু করে গুলির শিকার হয়। তবে যেসব স্পটে সবচেয়ে বেশি প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার হয় তারমধ্যে যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর ও উত্তরা অন্যতম।
অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিশেষজ্ঞ পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. নাজমুল হুদা বলেন, আসলে ৭.৬২ ক্যালিবার চায়না রাইফেল একটি ভয়ঙ্কর প্রাণঘাতী অস্ত্র। এটি ব্যবহারে অনেক সুবিধা। লক্ষ্য অর্জনে অত্যন্ত কার্যকরী। এই অস্ত্র সচরাচর ব্যবহার হয় না। বেসামরিক মানুষের ওপর এই অস্ত্র ব্যবহারের প্রশ্নই ওঠে না। কোনো দেশই এটা করে না। এর বুলেট একটি আস্তো আঙ্গুলের মতো। ৩০০ মিটারের মধ্যে কাউকে যদি এসএমজি ও চায়না রাইফেল দিয়ে গুলি করা হয়, তার মারা যাওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ। বেঁচে গেলেও যে অরগানে এই বুলেট লাগবে তা কেটে ফেলতে হবে। এমনকি দূরবর্তী নিশানা থেকেও যদি এই অস্ত্র দিয়ে গুলি করা হয়, গুলি যেখানে লাগবে তা ছিদ্র হয়ে বেরিয়ে যাবে। হাতে লাগলে হাত ছিঁড়ে যাবে। পায়ে লাগলে পা ছিঁড়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এটা এতটাই প্রাণঘাতী যে এই অস্ত্র মানুষের শরীরে বিদ্ধ হয়ে ভেতরে থেকে গেলেও বাঁচার চান্স নেই। কারণ এর তেজস্ক্রিয়া অতিমাত্রায় খারাপ ইফেক্ট ফেলে। পুরো শরীর ছড়িয়ে যায়।
সাবেক একজন সেনা কর্মকর্তা বলেন, ৭.৬২ ক্যালিবার এমএম চাইনিজ রাইফেলের কার্যকারিতা উচ্চ পর্যায়ের। এটা লোহার পাত ৬ মিলিমিটার, ইটের দেয়াল ১৫ মি:মি, মাটির দেয়াল ৩০ সেন্টিমিটার, কাঠের তক্তা ৪০ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার ভেদ করে চলে যেতে পারে। সেখানে মানুষের শরীর তো নরম জিনিস। এর একটি গুলির ওজন ১৬.৪ গ্রাম, বুলেটের ওজন ৭.৯ গ্রাম। চায়না রাইফেল দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে ৩০/৪০ রাউন্ড ছোড়া যায়। এখানে বিডি-৮ অ্যাসল্ট রাইফেল ব্যবহার করা হয়েছে। এটা অতি মারাত্মক। এর কার্যকারিতা ৫০০ মিটার পর্যন্ত যেতে পারে। সামরিক বাহিনী এই অস্ত্র ব্যবহার করে থাকে।
ছাত্র আন্দোলন দমাতে বিভিন্ন বাহিনী অচেনা নানা প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে। এসব অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে প্রজেক্টাইল, মাল্টি ইম্প্যাক্ট, রেন্ডম মুভমেন্ট, কাইনেটিভ, ভারী বল কার্তুজ ও হ্যান্ড গ্রেনেড। গত ১৯শে জুলাই মোহাম্মদপুরে এসআই শহিদুল ২০টি ও এসআই মাসুম বিল্লাহ ১১টি প্রজেক্টাটাইল নিক্ষেপ করেন। এ ছাড়া রামপুরায় কনস্টেবল আশিকুর ৪টি, যাত্রাবাড়ীতে কনস্টেবল মারুফ ১টি, সোহেল ৪টি, ইমরান ২টি, শামীম ৫টি, সাদেকুল ৩টি প্রজেক্টাটাইল নিক্ষেপ করেন বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়। ওইদিন মোহাম্মদপুরে এএসআই রাজু আহমেদ ৪ পিস, রামপুরায় কনস্টেবল আব্দুল কুদ্দুস ৫টি গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। এ ছাড়া মাল্টি ইম্প্যাক্ট ৩টি, র্যান্ডম মুভমেন্ট ৩টি, কাইনেটিভ ৬৮টি, ভারী বল কার্তুজ ৬২টি ও ৪টি ফ্লাস ব্যবহার করা হয়।
আপনার মতামত জানানঃ