তীব্র গরমে রাতে ১৬ হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি উঠছে বিদ্যুতের চাহিদা। যদিও এ চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে হচ্ছে না বিদ্যুৎ উৎপাদন। সারা দেশে এখন লোডশেডিং বাড়ছে। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকাগুলোয় ভোগান্তির মাত্রা এখন চরমে। এর বিপরীতে রাজধানী ঢাকাসহ শহরাঞ্চলে লোডশেডিং তুলনামূলক কম বলে গ্রাহক ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
ঢাকার বাইরে অন্তত ১০ জেলার বিদ্যুৎ গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব এলাকায় দিনে ও রাতে অন্তত ৮-১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। বিশেষ করে সন্ধ্যার দিকে বিদ্যুৎ আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকলেও গভীর রাতে অন্তত ৪-৫ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। এসব এলাকায় রাজধানীসহ দেশের বড় শহরগুলো থেকে ঈদযাত্রীরা আসতে শুরু করেছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে গ্রামাঞ্চলে জনভোগান্তি আরো তীব্র হয়ে ওঠার বড় আশঙ্কা রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রীষ্মের প্রকোপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের চাহিদাও বাড়ছে। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন করতে না পারায় সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় বিতরণ কোম্পানিগুলোকে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। দেশের সিংহভাগ বিদ্যুতের গ্রাহক বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (বিআরইবি) আওতাধীন এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় সেখানেই গ্রাহক ভোগান্তি সবচেয়ে বেশি।
সঞ্চালন সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেডের (পিজিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, ১১ জুন দিনের বেলায় বিদ্যুতের প্রকৃত উৎপাদন ছিল ১৪ হাজার ১৬৭ ও রাতের বেলায় ১৫ হাজার ৭৯৮ মেগাওয়াট। আর গতকাল দিনে বিদ্যুৎ চাহিদার প্রাক্কলন ছিল ১৪ হাজার ৮০০ ও রাতে ১৬ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। রাতে এ প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত গতকালের বিদ্যুৎ উৎপাদন তথ্য হালনাগাদ করা হয়নি।
বিকাল ৫টা পর্যন্ত হালনাগাদকৃত লোডশেডিংয়ের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল সর্বোচ্চ ১ হাজার ৫৫ থেকে সর্বনিম্ন ২৮৩ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং করতে হয়েছে। এর আগে মঙ্গলবার রাত ১টায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৬ হাজার ১০০ মেগাওয়াট, সেখানে সরবরাহ হয়েছে ১৪ হাজার ৯৯৫ মেগাওয়াট। লোডশেডিং দেখানো হয়েছে ১ হাজার ৫৫ মেগাওয়াট। গতকাল দুপুরে লোডশেডিং ৩০০-৪০০ মেগাওয়াটের ভেতরে থাকলেও বিকাল থেকে তা বাড়তে থাকে। বিকালে লোডশেডিং হয়েছে ৬৫০ থেকে ৭৪৯ মেগাওয়াট পর্যন্ত।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) কর্মকর্তারা বলছেন, গ্যাসের সংকট থাকায় চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। এছাড়া বিআরইবি এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ হ্রাস ও লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ার পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে দুর্বল বিতরণ ব্যবস্থা। এ দুর্বল বিতরণ ব্যবস্থার কারণেই বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিচ্ছে।
সারা দেশে লোডশেডিংয়ের মাত্রা বাড়ছে গত মাসের শেষ দিক থেকে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিপিডিবির সদস্য (বিতরণ) রেজাউল করিম গত সপ্তাহে গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘বিদ্যুতের চাহিদা ও উৎপাদনে কিছুটা ঘাটতি হচ্ছে এটা সত্য। সেটি গ্যাসের কারণে। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতি বেড়ে এখন দুই হাজার মেগাওয়াটে দাঁড়িয়েছে। আগে যেখানে গ্যাস থেকে সাত হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যেত, সেখানে এখন পাঁচ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন হচ্ছে। এর বাইরে ময়মনসিংহসহ বেশকিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহে কিছুটা সমস্যা রয়েছে। তবে সেটি খুব বেশি নয়। সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে।’
দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা যশোর, ঝিনাইদহ, খুলনা ও সাতক্ষীরায় গত কয়েক দিনে লোডশেডিংয়ের তীব্রতা বেড়েছে। এ বিষয়ে সাতক্ষীরা সদর উপজেলার বিদ্যুতের গ্রাহক আব্দুল আজিজ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ের পর বিদ্যুতের লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর সেটি ঠিক হলেও লোডশেডিং ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। দিনের বেলায় বিদ্যুৎ কম আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকলেও রাতের বেলায় অন্তত ৫-৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। পরিস্থিতি এতটাই অসহনীয় হয়ে উঠেছে যে গরমের কারণে বিভিন্ন ধরনের রোগবালাই ছড়াতে শুরু করেছে। বিদ্যুৎ না থাকায় দোকানপাট থেকে শুরু করে সব ধরনের প্রতিষ্ঠান এমনকি হাসপাতালেও ভোগান্তি এখন চরমে।’
একই অভিযোগ করেন ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার বাসিন্দা মিনুয়ারা বেগম। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘দিন-রাত মিলিয়ে পাঁচ-সাতবার লোডশেডিং হচ্ছে। একবার বিদ্যুৎ বন্ধ হলে কখনো দেড়-দুই ঘণ্টার আগে আসছে না। লোডশেডিং তীব্র হচ্ছে রাতের বেলায়। গরমে রাতের বেলায় ঠিকমতো ঘুম না হওয়ায় আমি ও পরিবারের অন্য সদস্যরা অসুস্থ হয়ে পড়ছি।’
ঘূর্ণিঝড় রেমালের সময় দেশের ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির আওতায় প্রায় পৌনে তিন কোটি গ্রাহক বিদ্যুৎহীন ছিল, যা মোট গ্রাহকের প্রায় ৫৮ শতাংশ। ঘূর্ণিঝড়ের পর সংযোগ স্বাভাবিক হলেও গ্রীষ্মের প্রকোপ বাড়ায় লোডশেডিং ব্যাপক হারে বাড়ছে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উৎপাদন তীব্র সংকটে পড়েছে।
এ বিষয়ে কথা বলতে যোগাযোগ করেও বিআরইবির সদস্য (বিতরণ ও পরিচালন) দেবাশীষ চক্রবর্তীর কাছ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের এক কর্মকর্তা নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিদ্যুতের উৎপাদন ঘাটতি রয়েছে। বিআরইবি চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কিছুটা কম পাচ্ছে। তবে গ্রাহক বেশি থাকায় বিদ্যুৎ বিতরণে ঘাটতি তৈরি হয়েছে। ফলে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। লোডশেডিংয়ের আরেকটি বড় কারণ বিতরণ ব্যবস্থার দুর্বলতা।’
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২৭ হাজার মেগাওয়াট। বর্তমানে গড় চাহিদা সাড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু গ্যাসের অভাবে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর অর্ধেক সক্ষমতা বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। অন্যদিকে জ্বালানি তেলের উচ্চ মূল্য ও ডলার সংকটের কারণে সেখান থেকেও পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। সময়মতো বিল পরিশোধ না করায় কমেছে আমদানীকৃত বিদ্যুতের পরিমাণও।
আপনার মতামত জানানঃ