স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদনের পাশাপাশি প্রতিবেশী ভারত থেকে আমদানির মাধ্যমে বিদ্যুতের চাহিদা মেটাচ্ছে বাংলাদেশ। দেশের মোট বিদ্যুৎ সরবরাহের ১২ শতাংশই করা হচ্ছে আমদানির মাধ্যমে। গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) বিদ্যুৎ আমদানিতে ব্যয় হয়েছিল ৯ হাজার ২২৩ কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ বাবদ ব্যয় হতে পারে ১৭ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। সেক্ষেত্রে এবার দেশে বিদ্যুৎ আমদানিতে ব্যয় বাড়তে পারে প্রায় ৮ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা বা ৯০ শতাংশের বেশি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিতের চেয়ে আমদানি করা বিদ্যুতে খরচ তুলনামূলক কম। এ কারণে অর্থ সাশ্রয়ের জন্য বিদ্যুতের আমদানি বাড়াচ্ছে সরকার। চলতি অর্থবছরে বিদ্যুৎ কেনায় ব্যয় বাড়তে যাচ্ছে সরকারের। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট চূড়ান্ত করা হয়।
এতে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদ্যুৎ ক্রয়ে সংস্থাটির ব্যয় হবে ৮৮ হাজার ৫৩২ কোটি টাকা। যেখানে এর আগের অর্থবছরে ব্যয় হয়েছিল ৮২ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরে বিদ্যুৎ আমদানিতে ব্যয় হবে ১৭ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। যেখানে এর আগের অর্থবছরে ৯ হাজার ২২৩ কোটি টাকার বিদ্যুৎ আমদানি করেছিল সরকার।
দেশে আমদানীকৃত বিদ্যুতের পুরোটাই আসছে প্রতিবেশী ভারত থেকে। দেশটির সরকারি ও বেসরকারি—উভয় উৎস থেকেই এ বিদ্যুৎ আনা হচ্ছে। এর মধ্যে সরকারি চুক্তির আওতায় আমদানি হচ্ছে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট। আর দেশটির বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানি আদানি গ্রুপের কাছ থেকে আসছে ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত দেশটি থেকে মোট ২ হাজার ৭৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি রয়েছে।
বিপিডিবির আর্থিক প্রতিবেদনের হিসাব অনুযায়ী, একক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে সংস্থাটি গত অর্থবছরে ৮৭ হাজার ২৪ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ কিনেছে। এর মধ্যে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি হয়েছে ১০ হাজার ৪২৫ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা। মোট সরবরাহের ভারত থেকে আমদানীকৃত বিদ্যুতের অবদান ছিল প্রায় ১২ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এর আগের ২০২১-২২ অর্থবছরে বিপিডিবি ভারত থেকে ৭ হাজার ৭১২ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ আমদানি করেছিল। এক বছরের ব্যবধানে বিদ্যুৎ আমদানির পরিমাণ বেড়েছে ৩৫ শতাংশের বেশি।
বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. হাবিবুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এবার বিদ্যুৎ আমদানি বেশি হচ্ছে, তাই খরচও বেশি হবে। এ মুহূর্তে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি না হলে ভয়াবহ লোডশেডিং হতো। তাছাড়া বিদ্যুতের দামের তুলনা করলে বর্তমানে ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুতের দাম সবচেয়ে কম। এতে আমাদের অর্থ সাশ্রয় হয়। সরকারের নীতি হচ্ছে আমাদের যে পরিমাণ বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে তার ১৫ শতাংশ পর্যন্ত আমদানি করা যাবে। আমদানির ওপর যাতে পুরোপুরি নির্ভরশীলতা তৈরি না হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।’
বেসরকারি ও ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চেয়ে আমদানি বিদ্যুতে গত অর্থবছর কিলোওয়াটপ্রতি বিদ্যুৎ ব্যয় কম হয়েছে বিপিডিবির। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিপিডিবির আর্থিক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বেসরকারি বা আইপিপি থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ে বিপিডিবির কিলোওয়াটপ্রতি গড় ব্যয় হয়েছিল ১৪ টাকা ৬২ পয়সা আর ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ব্যয় হয়েছিল ১২ টাকা ৩৫ পয়সা। অন্যদিকে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে ব্যয় ছিল কিলোওয়াটপ্রতি ৮ টাকা ৭৭ পয়সা।
২০২২-২৩ অর্থবছরে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়েছিল ৯ হাজার ২২৩ কোটি ৪১ লাখ টাকার। যেখানে আইপিপি থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ে বিপিডিবির ব্যয় ছিল ৫৯ হাজার ২২ কোটি ৭৪ লাখ টাকা এবং ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ে ব্যয় ছিল ৩ হাজার ৭৪৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে চলতি অর্থবছরে দেশের আইপিপি, এসআইপিপি ও রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ কেনার ব্যয় কমবে। এর বিপরীতে বাড়বে অন্যান্য উৎস থেকে কেনার ব্যয়। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরে আইপিপি ও এসআইপিপি থেকে বিদ্যুৎ কেনায় ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৭ হাজার ৭২২ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে এ বাবদ ব্যয় হয়েছিল ৪২ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা।
রেন্টাল কেন্দ্রগুলো থেকে এবার বিদ্যুৎ কেনায় ব্যয় হবে ২ হাজার ৩২০ কোটি টাকা। যেখানে এর আগের অর্থবছরে ব্যয় হয়েছিল ৩ হাজার ৭৪৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি (এনডব্লিউপিজিসিএল), বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি (বিসিপিসিএল) ও বাংলাদেশ ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি (বিআইএফপিসিএল) থেকে ১৯ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকার বিদ্যুৎ কিনবে বিপিডিবি। গত অর্থবছরে কেনা হয়েছিল ১৮ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকার বিদ্যুৎ। রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড থেকে (আরপিসিএল) থেকে এবার বিদ্যুৎ কেনায় ৪ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।
গতবার প্রতিষ্ঠানটি থেকে বিদ্যুৎ কেনা হয়েছিল ৩ হাজার ৬১৫ কোটি টাকার। আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ক্রয় বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ১০৩ কোটি টাকা, যেখানে এর আগের অর্থবছরে ব্যয় হয়েছিল ৩ হাজার ৩০৬ কোটি টাকা। ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশের (ইজিসিবি) কাছ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকার বিদ্যুৎ কিনবে বিপিডিবি। গত অর্থবছরে কোম্পানিটি থেকে বিদ্যুৎ কেনা হয়েছিল ১ হাজার ৭৯২ কোটি টাকার।
এ বিষয়ে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বিপিডিবির নির্ভরযোগ্য এক সূত্র গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে ব্যয় জ্বালানি তেল বা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর চেয়ে কম। ফলে বিপিডিবির বিদ্যুৎ ক্রয়ে যেখান থেকে বেশি সাশ্রয় হবে, সেখান থেকেই বিদ্যুৎ কেনার অগ্রাধিকার রয়েছে। সেটা আমদানি বা বেসরকারি হোক। তাছাড়া ভারতের সঙ্গে করা চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎ কিনে বিগত বছরগুলোয় সাশ্রয় হয়েছে।’
বিপিডিবির গত ২ এপ্রিলের বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সন্ধ্যায় পিক আওয়ারে ১৩ হাজার ৭০৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ হয়েছে। এর মধ্যে স্থানীয় পর্যায়ের উৎপাদন ছিল ১২ হাজার ৭১ মেগাওয়াট। আর ভারত থেকে আমদানি হয়েছে ১ হাজার ৬৩৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এর মধ্যে আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ১ হাজার ১০ মেগাওয়াট, ভেড়ামারা (এইচভিডিসি) কেন্দ্র থেকে ৪৯০ মেগাওয়াট ও ত্রিপুরা থেকে ১৩৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়েছে।
জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘স্থানীয় বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে ভারত থেকে কম মূল্যে বিদ্যুৎ আমদানিতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনে ভারত কেন কম মূল্যে উৎপাদন করতে পারছে, আমরা কেন পারছি না, সেই বিষয়গুলোর বিশ্লেষণ হওয়া দরকার। তারা যেসব প্রযুক্তি মেনে চলছে, যে ধরনের জ্বালানি ব্যবহার করছে সেগুলোর মৌলিক বিষয় একই রকম। যে পরিমাণ বিদ্যুৎ আমদানি হচ্ছে, তা বাংলাদেশে করা গেলে দক্ষ জনবল গড়ে ওঠার পাশাপাশি দেশে বড় ধরনের কর্মসংস্থান তৈরি করা যেত। এতে করে আমদানিনির্ভরতা কমানো সম্ভব হতো।’
আপনার মতামত জানানঃ