বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ -ব্যবসা থাকা ও নির্বাচনী হলফনামায় সেসব সম্পদের উল্লেখ না করায় আলোচিত সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেছেন যে তিনি মন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে ‘এক টাকার দুর্নীতি হয়েছে প্রমাণ হলে’ তিনি সংসদ সদস্যের পদ থেকে সরে দাঁড়াবেন।নির্বাচনের আগে তার বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচার ও হলফনামায় সম্পদের বিবরণ না দেয়ার অভিযোগে আলোচনা-সমালোচনা তৈরি হয়েছিল।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পরে নতুন মন্ত্রিসভায় তিনি ডাক পাননি। তবে তাকে ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়েছে।
শনিবার দুপুরে ঢাকায় প্রেস ক্লাবে একটি সংবাদ সম্মেলনে তিনি দাবি করেন যে তিনি বেআইনি পন্থায় বিদেশে টাকা নেননি এবং যথাযথ নিয়ম মেনেই নির্বাচনী হলফনামা পূরণ করেছেন। মন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম নিয়ে তদন্ত করার জন্য ‘হাই পাওয়ার কমিটি’ গঠন করার আহ্বান করেন তিনি।
“আমি পাঁচ বছর ভূমিমন্ত্রী ছিলাম, তার আগে প্রতিমন্ত্রীও ছিলাম। আমি মন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে কোনো দুর্নীতি হয়েছে কিনা তদন্ত করার জন্য একটি হাই পাওয়ার কমিটি গঠন করা হোক”, বলছিলেন মি. চৌধুরী।
সেসময় তিনি বলেন, “আমি এক টাকার দুর্নীতি করেছি তা দেখাতে পারলে এমপি পদ ছেড়ে দেবো।”
সংবাদ সম্মেলনে মি. চৌধুরী তার মন্ত্রিত্বকালীন কর্মকাণ্ড ছাড়াও তার ব্যবসা, বিদেশে থাকা সম্পদ ও নির্বাচনী হলফনামা নিয়ে কথা বলেন। গত বছরের ২৬শে ডিসেম্বর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ. টিআইবি এক সংবাদ সম্মেলনে জানায় যে বাংলাদেশের একজন মন্ত্রীর বিদেশে ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকার ব্যবসা রয়েছে এবং তিনি নির্বাচনী হলফনামায় সেই তথ্য দেননি।
টিআইবি সংবাদ সম্মেলনে ঐ মন্ত্রীর নাম প্রকাশ না করলেও একদিন পর বিভিন্ন পত্রিকার রিপোর্টে প্রকাশিত হয় যে ঐ মন্ত্রী ভূমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা সাইফুজ্জামান চৌধুরী।
পরে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বিবিসি বাংলাকে নিশ্চিত করেছেন যে যে তাদের গবেষণায় যে মন্ত্রীর বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে ঐ মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীই ছিলেন।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সেসময় বলেছিলেন যে, যে উৎসগুলো থেকে তারা মন্ত্রীর এসব সম্পদের বিষয়ে জানতে পেরেছেন তা উন্মুক্ত ওয়েবসাইট। সেখানে শুধু সম্পদের হিসাব রয়েছে।
কিন্তু এসব সম্পদ গড়তে মন্ত্রী কোন উপায়ে অর্থ নিয়েছেন তা বলা হয়নি। যার কারণে মন্ত্রী কীভাবে অর্থ নিয়ে গেছেন সেটি তাদের পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি।
বিদেশে ব্যবসা নিয়ে যা বললেন
সংবাদ সম্মেলনে সাইফুজ্জামান চৌধুরীকে প্রশ্ন করা হয় যে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি না নিয়ে বিদেশে অর্থ লগ্নি করে তিনি অপরাধ করেছেন কি না। উত্তরে মি. চৌধুরী বলেন তিনি বাংলাদেশ থেকে কোনো টাকা বিদেশে নেননি, কাজেই বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নেয়ারও প্রয়োজন ছিল না তার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমতি না নেয়া ও বাংলাদেশ থেকে টাকা লগ্নি না করার বিষয়টি ব্যাখ্যাও করেন তিনি। তিনি জানান, “আমার বাবা ইংল্যান্ডের সাথে ট্রেডিং ব্যবসা শুরু করেন ১৯৬৭ সালে। ঐ সূত্রেই আমাদের পরিবারের ব্যবসা শুরু। আমি আমেরিকায় পড়ালেখা শেষ করার পর আশির দশকের শেষদিক থেকে বিদেশেই ব্যবসা করেছি।”
সাইফুজ্জামান চৌধুরীর দাবি অনুযায়ী, দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশের বাইরে তার পরিবারের ট্রেডিং, রেস্টুরেন্ট, সুপার মার্কেট, রিয়েল এস্টেট সহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা ছিল। আর এসব ব্যবসার শুরু এবং প্রসার বাংলাদেশের বাইরে হওয়ায় বাংলাদেশের সাথে এসব ব্যবসার কোনো আর্থিক সংযোগ নেই।
অর্থাৎ, তার দাবি অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে কখনো কোনো টাকা বিদেশে নিতে হয়নি তার। যে কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমতি নেয়ারও প্রয়োজন পড়েনি।
“আমি বাংলাদেশ থেকে টাকা বাইরে নেইনি, নিলে অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিতাম। বাংলাদেশ থেকে টাকা বাইরে না নিয়েও ব্যবসা করা যায়, যদি দীর্ঘসময় ধরে প্রমাণিত ট্র্যাক রেকর্ড থাকে। এসব ব্যবসা আমি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি”, বলেন মি. চৌধুরী।
বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ভূমিমন্ত্রী নিজে এবং তার স্ত্রী মিলে বিদেশি অন্তত ছয়টি কোম্পানি পরিচালনা করছেন বলে তথ্য দেয়া হয়। যেগুলোর মূল্য ১৬.৬৪ কোটি পাউন্ড বা দুই হাজার ৩১২ কোটি টাকা বলে জানানো হয়।
বিভিন্ন সংবাদপত্রের রিপোর্টে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্য সরকারের ওয়েবসাইটে গিয়ে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর নামে অন্তত ছয়টি কোম্পানি পাওয়া যায় যার সবগুলোই আবাসন ব্যবসার সাথে যুক্ত।
এগুলো হচ্ছে, জেডটিজেড প্রোপার্টি ভেনচার্স লিমিটেড, আরামিট প্রোপার্টিজ লিমিটেড, রুখমিলা প্রোপার্টিজ লিমিটেড, সাদাকাত প্রোপার্টিজ লিমিটেড, জেবা প্রোপার্টিজ লিমিটেড এবং জারিয়া প্রোপার্টিজ লিমিটেড। এই সবগুলো কোম্পানিরই পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন তিনি।
এর মধ্যে শুধু রুখমিলা প্রোপার্টিজ লিমিটেড এর পরিচালক পদ থেকে তিনি সরে দাঁড়িয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই কোম্পানিটির ঠিকানা লন্ডনের ওয়ারউইক লেন। বাকি সবগুলো কোম্পানির ঠিকানা লন্ডনের ডেভনশায়ার স্কয়ার উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, বিদেশে বিনিয়োগ করার নিয়ম নেই।
হলফনামায় বিদেশে ব্যবসার উল্লেখ না থাকা
সাতই জানুয়ারির নির্বাচনের আগে সাবেক ভূমি প্রতিমন্ত্রীর ‘নির্বাচনী হলফনামায়’ বিদেশের মাটিতে থাকা সম্পদের বিবরণ না থাকার বিষয়টি প্রকাশিত হলে আলোচনা-সমালোচনা তৈরি হয়। হলফনামায় কেন সম্পদের উল্লেখ করেন নি, এই প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই মন্ত্রী বলেন হলফনামায় ‘বিদেশে সম্পদ উল্লেখ করার কোনো কলাম নেই।’
তিনি বলেন, “বিগত নির্বাচনগুলিতে যেভাবে হলফনামা পূরণ করেছি, এই নির্বাচনেও সেভাবেই করা হয়েছে। বাংলাদেশের ট্যাক্স রিটার্নের সাথে মিল রেখে হলফনামা করতে হয়।”
“হলফনামায় কোথাও কলাম নেই বিদেশি সম্পত্তি উল্লেখ করার জন্য। যেহেতু কোনো কলাম নেই ও বিগত নির্বাচনেও আমি এ বিষয়ে কোনো তথ্য দেইনি, তাই এবারও ঐ তথ্য দেইনি।”
মি. চৌধুরী দাবি করেন তিনি তার বাংলাদেশের ব্যবসা ও যুক্তরাজ্যের ব্যবসা আলাদাভাবে পরিচালনা করেন এবং দুই দেশেই নিয়ম অনুযায়ী ট্যাক্স দেন।
“যেহেতু হলফনামায় কলামে নেই, আমি বাড়তি কথা কেন বলতে যাবো। সে কারণেই ‘অন গুড ফেইথ’ আমি দীর্ঘদিন ধরে যেভাবে কাজ করে এসেছি, সেভাবেই হলফনামা পূরণ করেছি”, বলেন মি. চৌধুরী।
এভাবে হলফনামা পূরণ করার পেছনে কোনো ‘খারাপ উদ্দেশ্য’ ছিল না বলে দাবি করেন মি. চৌধুরী।
সম্পদের বাজারমূল্য নিয়ে যা বললেন
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তৎকালীন ভূমি মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিদেশে থাক ব্যবসা সম্পর্কে যেসব খবর প্রকাশিত হয়েছিল, সেখানে উঠে আসে যে বিদেশে মি. চৌধুরীর সম্পদের বাজারমূল্য দুই হাজার তিনশো কোটি টাকার বেশি।
সম্পদের এই মূল্যায়ন বৈদেশিক মুদ্রার বর্তমান বিনিময় মূল্যের হিসেবে হওয়ায় এটিকে অতিরঞ্জিত বলে দাবি করছেন মি. চৌধুরী।
তিনি বলেন, “আমার বাবা ১৯৬৭ সালে বিদেশে ব্যবসা শুরু করেন। আমি ১৯৯১ সাল থেকে ব্যবসা করেছি ও পারিবারিক ব্যবসার সম্প্রসারণ করেছি। কিন্তু ঐ ব্যবসার বাজারমূল্য আজকে থেকে ১০-১৫ বছর আগের পাউন্ডের বিনিময় মূল্য বিবেচনা করে হিসেব করা হলে যা আসবে, বর্তমান বিনিময় মূল্যের হিসেবে করলে তার চেয়ে অনেক বেশি আসবে।”
বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় তার বিদেশে থাকা ব্যবসার মূল্যমানও বেশি হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে বলে দাবি করেন মি. চৌধুরী।
আপনার মতামত জানানঃ