সাতই ডিসেম্বর ভারত পেঁয়াজ রপ্তানির নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পরপরই বাংলাদেশে রাতারাতি প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায় পেঁয়াজের দাম।
এরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যায় একরকম বয়কটের ডাক। কেউ বলেন এক সপ্তাহের জন্য, কেউ বলেন দশ থেকে পনেরো দিনের জন্য পেঁয়াজ কেনা বাদ দিতে।
এমন প্রায় সব পোস্টের যুক্তি একই ধরণের, এভাবে সবাই মিলে বর্জন করলে পেঁয়াজ পচে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে সিন্ডিকেটের কারসাজি ভেঙ্গে দেয়া সম্ভব হবে এবং দাম কমে আসবে।
ক্রিয়েটিভ ডিজাইনিং পেশায় থাকা মোঃ মনোয়ার হোসেন তেমন একটি পোস্ট শেয়ার করেন যেখানে ১৫ দিন পেঁয়াজ না খেয়ে মানিয়ে নেয়ার কথা বলা হচ্ছে।
তিনি বলছিলেন মাংসের দাম কমার যে উদাহরণ সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে সেখান থেকেই তাঁর কাছে সমষ্টিগতভাবে এভাবে বর্জন করাটা যৌক্তিক মনে হয়েছে।
উচ্চ মূল্যের কারণে মানুষ গরুর মাংস কেনা কমিয়ে দিলে এর প্রভাবে দাম কমে যায়। যদিও চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি থাকাও একটা ফ্যাক্টর ছিল। প্রশ্ন হচ্ছে, দাম বেড়ে যাওয়ার পর মানুষ যদি ক্রয় কমিয়ে দেয় তাহলে কি দাম কমে?
পেঁয়াজের ক্ষেত্রে যা হচ্ছে
গত এক সপ্তাহে বাজারগুলো ঘুরে দেখা গেছে পেঁয়াজের ক্রেতা তুলনামূলক কম। যারাও কিনছেন তাদের অনেকে কয়ের ক্ষেত্রে রাশ টেনে ধরেছেন। এর আগে সেপ্টেম্বর মাসে সরকার দেশি পেঁয়াজ ৬৪-৬৫ টাকা কেজি দরে বেঁধে দিলেও বিক্রি হচ্ছিল ৮০-৮৫ টাকায়। এদফায় ৮ই ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০০ টাকার আশেপাশে থাকা দাম হঠাৎ করে ২০০ ছাড়িয়ে যায়।
ঢাকার আদাবর এলাকার একজন খুচরা ব্যবসায়ী মোঃ ইউসুফ জানালেন ১৪ই ডিসেম্বর ভারতীয় পেঁয়াজ এবং পুরাতন দেশী পেঁয়াজ দুটোই ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন, তবুও ক্রেতার ঘাটতি রয়েছে। নতুন পেঁয়াজ ১৯০ টাকা কেজি শুনে আর দোকানে তুলেননি তিনি।
তিনি বলছিলেন, “অনেকে কেনা কমিয়ে দিয়েছে, নতুন পেঁয়াজ আসছে বাজারে, আর সিন্ডিকেটের বাজারে সবার কাছে আগের দামের পণ্য রয়ে গেছে যেটা সবাই বিক্রি করতে চাচ্ছে কিন্তু মানুষ সেভাবে কিনছে না এজন্য দামও কমে আসছে।”
এছাড়া ভারত থেকেও আমদানিতে নতুন ঋণপত্র খোলার সুযোগ না থাকলেও আগে ঋণপত্র খোলা হয়েছিল এমন অনেক পেঁয়াজও বাজারে আসছে, ফলে সরবরাহের ঘাটতি নেই বলে জানান ইউসুফ।
অথচ ভারত রপ্তানি করবে না এমন ঘোষণার পর পর পরিস্থিতি এমন তৈরি হয়েছিল যেখানে মনে হচ্ছিলো চাহিদার তুলনায় বাজারে সরবরাহের ঘাটতি রয়েছে।
ডিসেম্বরের ১০ তারিখ কারওয়ান বাজারের একজন আড়তদার বিবিসিকে জানিয়েছিলেন যে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খুচরা ব্যবসায়ীদের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দ্রুত মজুত ফুরিয়ে আসছে বলে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন তারা।
এছাড়া বছরের এই সময়টায় নতুন পেঁয়াজ বাজারে আসার আগে পেঁয়াজের কিছুটা সংকট থাকার কথাও উঠে এসেছিল। তবে মানুষ কেনা কমিয়ে দেয়ার প্রেক্ষাপটে দাম অনেকটাই কমলেও আগের পর্যায়ে এখনো আসেনি। আর এর পেছনে নভেম্বর-ডিসেম্বরের এই সময়টার কথাও উঠে আসে বিশ্লেষকদের কথায়।
তারা বলছেন, যখন দেশীয় পেঁয়াজ উৎপাদনের সময় না এবং বাজারটা হয়ে পড়ে আমদানিনির্ভর। এজন্য বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে সহজ আমদানির জায়গা ভারত রপ্তানি করতে না চাইলে বাংলাদেশে এর বড় প্রভাব সৃষ্টি হয় বলছিলেন অর্থনীতিবিদ এবং সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ।
দাম বাড়লে কেনা বাড়ে, এবার ভিন্ন কেন?
খুচরা বিক্রেতা মোঃ ইউসুফ এর আগে দেখেছেন যখন দাম বাড়তে থাকে তখন মানুষের কেনার প্রবণতা বেড়ে যায়। মূলত দাম আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে মানুষ আরো বেশি কিনতে থাকে যেটা বাজারে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে।
তবে পেঁয়াজের বেলায় এবার ভিন্ন চিত্রের পেছনে কয়েকটি বিষয় উঠে আসে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এবং বিশ্লেষকদের কথায়।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ বা ক্যাবের প্রেসিডেন্ট গোলাম রহমানও।
কেনা কমালে দাম কমে?
সাধারণত জিনিসপত্রের দাম নির্ভর করে সরবরাহ এবং চাহিদার ভিত্তিতে। সরবরাহের চাইতে চাহিদা বেড়ে গেলে দাম বাড়ে, আবার সরবরাহের তুলনায় চাহিদা কমে গেলে দাম কমে। অন্যদিকে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি হলে দাম কমে, সরবরাহ কমে গেলে দাম বাড়ে।
কিছু পরিস্থিতিতে মানুষ পণ্য কেনা বন্ধ করলে বা কমিয়ে দিলে দাম কমার মতো পরিস্থিতি হতে পারে।
“পণ্যটি হতে হবে পচনশীল, এমন অবস্থায় ক্রয় কমে গেলে দাম অবশ্যই কমবে” বলছিলেন ক্যাবের প্রেসিডেন্ট।
ড. মোয়াজ্জেমের মতে এভাবে বর্জন করে খুব একটা লাভ হওয়ার সুযোগ নেই যতক্ষণ চাহিদা থাকবে। তাঁর মতে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের ক্ষেত্রে একটা চাহিদা কমবেশি থাকেই এবং সাধারণভাবে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের চাহিদা নেই হয়ে যাবে না।
“পেঁয়াজের ক্ষেত্রে হয়তো নিম্ন আয়ের মানুষ উচ্চ মূল্যস্ফীতি-জনিত কারণে হয়তো পেঁয়াজ কিনছেন না, কিন্তু যিনি বাজারে পেঁয়াজ নিয়ে আসছেন, যেই দামে নিয়ে এসেছেন সেই দামে বিক্রি করতে না পারলে স্বাভাবিক বা প্রয়োজনীয় যে লাভটুকু তার দরকার সেটা থাকেনা” বলছিলেন তিনি।
গরুর মাংসের ক্ষেত্রে ভোগ কমে যাওয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা কারণে সরবরাহ উদ্বৃত্তের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় দাম কমার উদাহরণ দেন ড. মোয়াজ্জেম।
পেঁয়াজের ক্ষেত্রে চাহিদা আছে এবং সে তুলনায় বছরের এই সময়টায় সরবরাহ কম। যতক্ষণ না পর্যন্ত সরবরাহের নিচের পর্যায় থেকে শুরু করে সরবরাহ বৃদ্ধির এবং মূল্যহ্রাসের পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয় তাহলে খুচরা পর্যায়ে দাম কমার সুফল পাবে না বলে মনে করছিন তিনি।
সার্বিকভাবে ঘাটতির পরিস্থিতি থেকে দাম বাড়লে সেক্ষেত্রে সে পণ্য কেনা বাদ দিলেও খুব বেশি প্রভাব পড়ে না বলে মত দেন ড. মোয়াজ্জেম।
আপনার মতামত জানানঃ