বিজ্ঞানীরা ব্যাকটেরিয়ার এমন একটি স্ট্রেইন বা ধরন খুঁজে পেয়েছেন, যেটি মশা থেকে মানুষের শরীরে ম্যালেরিয়া জীবাণুর সংক্রমণ ঠেকাতে সক্ষম। হঠাৎ করেই ব্যাকটেরিয়ার এই স্ট্রেইনটি তারা আবিষ্কার করেছেন।
ল্যাবরেটরিতে সংরক্ষিত এক ঝাঁক মশার ভেতর ম্যালেরিয়ার জীবাণু তৈরি কেন বন্ধ হয়ে গেল, তার কারণ খুঁজতে গিয়ে ব্যাকটেরিয়ার এই ধরনটির সন্ধান পান বিজ্ঞানীদের একটি দল।
ঐ গবেষকরা এখন বলছেন, খুঁজে পাওয়া নতুন ধরণের এই ব্যাকটেরিয়া, যেটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবেশে বিরাজ করে। বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন এই প্রাণঘাতী রোগের মোকাবেলায় নতুন একটি অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
এখনও বিশ্বে প্রতি বছর ম্যালেরিয়ায় ছয় লাখ লোক মারা যায়। নতুন আবিষ্কৃত এই ব্যাকটেরিয়ার প্রয়োগে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের ট্রায়াল বা পরীক্ষা এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
স্পেনে ওষুধ কোম্পানি জিএসকের পরিচালিত একটি গবেষণাগারে বিজ্ঞানীরা হঠাৎ করে আবিষ্কার করেন যে একটি ওষুধ তৈরির গবেষণার প্রয়োজনে আটকে রাখা এক ঝাঁক মশার শরীরে ম্যালেরিয়ার জীবাণু তৈরি হচ্ছেনা।
ড. জ্যানেট রডরিগস্, যিনি জিএসকের ঐ ওষুধ তৈরির গবেষণায় নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, বলেন, “আমরা দেখলাম মশার ঐ কলোনিতে সংক্রমণ (ম্যালেরিয়া জীবাণুর) কমতে শুরু করেছে, এবং বছরের শেষ নাগাদ দেখা গেল তাদের মধ্যে ম্যালেরিয়া জীবাণুর সংক্রমণ একদম শূন্যে পৌঁছে গেছে।”
বিজ্ঞানীদের ঐ দলটি ২০১৪ সালের তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার স্যাম্পল বা নমুনা ডিপ-ফ্রিজে সংরক্ষণ করে রাখেন। এর দু’বছর পর সেই নমুনায় কি ঘটলো তা খুঁটিয়ে দেখেন।
এরপর আরো কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষায় বিজ্ঞানীরা দেখনে নতুন খুঁজে পাওয়া ঐ ব্যাকটেরিয়া, যেটিতে তারা নাম দিয়েছেন টিসি-ওয়ান এবং যেটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবেশেই অবস্থান করছে, মশার অন্ত্রনালীতে ম্যালেরিয়ার জীবাণু তৈরির প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিয়েছে।
“এটি (টিসি-ওয়ান ব্যাকটেরিয়া) কোনো মশার শরীরে ঢুকলে মশার জীবনচক্রের পুরোটা সময় ধরেই সক্রিয় থাকছে। এবং আমরা প্রমাণ পেয়েছি যে ঐ ব্যাকটেরিয়াই ঐ মশাগুলোর দেহে সংক্রমণ কমানোর পেছনে কাজ করেছে।“
বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী সায়েন্সে প্রকাশিত নতুন তথ্যে দেখা যাচ্ছে নতুন আবিষ্কৃত এই ব্যাকটেরিয়াটি মশার দেহে ম্যালেরিয়া জীবাণুর পরিমাণ ৭৩ শতাংশ কমিয়ে দিতে সক্ষম।
এই ব্যাকটেরিয়াটি হারমেন নামের একটি মলিকিউল বা ক্ষুদ্র একটি অণু নি:সৃত করে যেটি মশার অন্ত্র-নালিতে ম্যালেরিয়ার জীবাণু তৈরির প্রক্রিয়া আটকে দেয়।
জিএসকের এই বিজ্ঞানী দল এবং যুক্তরাষ্ট্রের জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা তাদের যৌথ গবেষণায় দেখেছেন ব্যাকটেরিয়ার নি:সৃত হারমেন মুখের সাহায্যে – যদি এর সাথে চিনি মেশানো যায় – অথবা ত্বকের ভেতর দিয়ে মশার শরীরে ঢোকানো সম্ভব। মশা যেখানে বসে সেখানে এই হারমেন ছড়িয়ে রেখে এটি নিশ্চিত করা সম্ভব।
গবেষণাগারের বাইরে বাস্তব জগতে হারমেন প্রয়োগে নিরাপদে এবং কার্যকরভাবে ম্যালেরিয়া দমন কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়ে এখন আফ্রিকার বুর্কিনা ফাসোতে ব্যাপক একটি ট্রায়াল বা পরীক্ষা চলছে।
আশা করা হচ্ছে বিজ্ঞানীরা ব্যাকটেরিয়া-ভিত্তিক নতুন একটি ওষুধ তৈরি করে খুব দ্রুত হয়তো বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন এবং প্রাণঘাতী এই রোগের মোকাবেলায় নতুন একটি অস্ত্র হাজির করতে সক্ষম হবেন।
এখনও বিশ্বে বছরে ৬২০,০০০ মানুষ ম্যালেরিয়ায় মারা যায়, যাদের বিশাল একটি অংশ পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু। ম্যালেরিয়ার টিকা এখন বাজারে এসেছে, কিন্তু ম্যালেরিয়া-উপদ্রুত আফ্রিকায় গণহারে তার প্রয়োগ এখনও একেবারেই প্রাথমিক স্তরে।
‘ম্যালেরিয়া নো মোর’ নামে একটি দাতা সংস্থার কর্মকর্তা গ্যারেথ জেনকিন্স বলেন নতুন এই আবিষ্কার সত্যিই আশাব্যঞ্জক।
“প্রতি মিনিটে একটি শিশু ম্যালেরিয়ায় মারা যাচ্ছে। ম্যালেরিয়ার প্রকোপ কমাতে হালে বেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, কিন্তু এই সাফল্য এগিয়ে নিতে আমাদের হাতে সৃজনশীল নতুন নতুন অস্ত্র প্রয়োজন।’
“নতুন নতুন আবিষ্কার এবং সৃজনশীল গবেষণা অব্যাহত রাখা গেলে আমাদের জীবদ্দশাতেই ম্যালেরিয়ার হুমকি নির্মূল করা সম্ভব।”
এসডব্লিউএসএস/১৩৩০
আপনার মতামত জানানঃ