প্রাণঘাতী রোগ ডায়াবেটিসের অস্তিত্ব সম্পর্কে মানবজাতি প্রথম অবগত হয় হাজার বছর পূর্বে। এর আগে এটি ছিল মানুষের কাছে পুরোপুরি অপরিচিত। ষোড়শ শতকের আগে আসলে এই রোগের প্রতিকার সম্পর্কে মানুষের কোনো ধারণাই ছিল না।
প্রাচীন মিশরের তৎকালীন চিকিৎসকেরা এক অদ্ভুত অথচ কার্যকর পদ্ধতিতে রোগীদের শরীরে ডায়াবেটিস রোগ শনাক্ত করতেন। প্রথমে মিশরীয় ডাক্তাররা সম্ভাব্য ব্যক্তির কাছ থেকে মূত্রের নমুনা সংগ্রহ করতেন। এরপর সেটি কোনো উন্মুক্ত জায়গা রেখে আসা হতো।
যদি দেখা যেত মূত্রের নমুনার আশেপাশে পিপড়ার দল হাজির হয়েছে, তখন ধরে নেয়া হতো যে ব্যক্তির মূত্রের নমুনা নেয়া হয়েছে, তার ডায়াবেটিস হয়েছে। ঠিক বিপরীতভাবে, যদি সংগৃহীত মূত্রের আশেপাশে পিপড়ার উপস্থিতি না থাকত, তাহলে ব্যক্তির ডায়াবেটিস হয়নি বলে চিকিৎসকেরা নিশ্চিত করতেন।
মিশরে যখন কোনো ব্যক্তির ডায়াবেটিস হয়েছে বলে নিশ্চিত করা হতো, তখন সেটি তার মৃত্যুপরোয়ানা হিসেবে ধরে নেয়া হতো। কারণ ডায়াবেটিস থেকে সেরে ওঠার কোনো পথ্য আবিষ্কৃত হয়নি তখনও। সাধারণত, ইনসুলিন আবিষ্কারের আগে কোনো ব্যক্তির ডায়াবেটিস ধরা পড়লে অভিজ্ঞ ডাক্তার বলে দিতেন, তারা বাঁচতে পারবেন আর মাত্র কয়েক মাস। ভাগ্য ভালো হলে রোগী সর্বোচ্চ এক বছর বাঁচতেন।
উনিশ শতকের আগে কোনো চিকিৎসাবিজ্ঞানী জানতেন না, রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার সাথে অগ্ন্যাশয়ে উৎপন্ন হওয়া ইনসুলিন নামক হরমোনের দারুণ সম্পর্ক রয়েছে। ১৮৮৯ সালে দুই জার্মান চিকিৎসাবিজ্ঞানী অস্কার মিনকোভস্কি এবং জোসেফ ভন মেরিং এক গবেষণা চালান।
এই গবেষণায় কয়েকটি কুকুরের দেহ থেকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ক্ষুদ্রান্ত্র থেকে অগ্ন্যাশয় গ্রন্থি সরিয়ে ফেলা হয়। এরপর তারা দেখতে পান, সাধারণত ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রে যে উপসর্গগুলো দেখা দেয় (রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যাওয়া, মূত্রের সমস্যা, এবং কিটোসিস), অগ্ন্যাশয়হীন কুকুরগুলোর ক্ষেত্রেও সেই উপসর্গগুলো দেখা দিচ্ছে।
মূলত এই গবেষণার মাধ্যমে তারা নিশ্চিত হন, অগ্ন্যাশয় থেকে এমন কোনো হরমোন উৎপন্ন হয়, যেটি আমাদের শরীরে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে। যখনই মানবদেহের অগ্ন্যাশয়ে সেই হরমোনের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়, তখনই রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে যায়, একপর্যায়ে এটি ডায়াবেটিসে রূপ নেয়।
তবে জার্মান মিনকোভস্কি এবং ভন মেরিং তাদের যুগান্তকারী গবেষণার মাধ্যমে ডায়াবেটিস রোগের সাথে অগ্ন্যাশয়ের সর্ম্পক নির্ধারণ করতে সক্ষম হলেও কোন অংশে সেই বিশেষ হরমোন উৎপন্ন হয়, এই সম্পর্কে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য দিতে পারেননি।
ইংরেজ চিকিৎসাবিজ্ঞানী স্যার অ্যালবার্ট এডওয়ার্ড শার্পি-শেফার হলেন সর্বপ্রথম ব্যক্তি, যিনি সঠিকভাবে ‘আইলেটস অফ ল্যাঙ্গারহ্যান্স’ নামক অংশের কিছু কোষের কথা বলেছিলেন, যেগুলো থেকে নির্গত হরমোন আমাদের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ঠিক রাখে।
১৯০১ সালে ইউরোপের বিজ্ঞানীরা আরেকটি গবেষণার মাধ্যমে দেখতে পান কুকুর, বিড়াল কিংবা ইঁদুরের অগ্ন্যাশয়ে যখন হরমোন নির্গমনের রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়, তখন আস্তে আস্তে ইনসুলিন নামের হরমোন নির্গমনকারী কোষগুলো মারা যেতে শুরু করে। এ কারণে দেহে ইনসুলিনের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়, রক্তে বেড়ে যায় গ্লুকোজের পরিমাণ, এবং সবশেষে দেখা দেয় ডায়াবেটিস। এই গবেষণার মাধ্যমে মানবদেহে ইনসুলিন হরমোনের উৎপাদন বন্ধ হওয়ার কারণের দিকে বিজ্ঞানীরা অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছিলেন।
তবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের সম্ভাব্য উপায় আবিষ্কারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে ১৯২০ সালের দিকে। কানাডিয়ান চিকিৎসাবিজ্ঞানী ফ্রেডেরিক ব্যান্টিং এবং তার সহযোগী চার্লস বেস্ট কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে গবেষণাগারে এমন একটি এনজাইম আবিষ্কার করতে সক্ষম হন, যেটি অগ্ন্যাশয় থেকে উৎপন্ন ইনসুলিনের অভাব পূরণে সক্ষম হবে।
বলা হয়ে থাকে, নিজেদের এই আবিষ্কার সম্পর্কে ব্যান্টিং এবং বেস্ট এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, অন্যান্য প্রাণীর দেহে তাদের আবিষ্কৃত এনজাইম প্রয়োগের পূর্বে তারা সর্বপ্রথম নিজেদের দেহে সেই এনজাইম প্রয়োগ করেন। তারা ফলাফল পেয়েছিলেন হাতেনাতে। রক্তে এনজাইম প্রবেশ করানোর পর গবেষণাগারে তারা নিজেদের রক্ত পরীক্ষা করে দেখতে পান, রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ ঠিকই আগের চেয়ে কমে গিয়েছে।
এরপর গবেষণার পরবর্তী ধাপে কিছু কুকুরের দেহ থেকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে পাকস্থলীর ইনসুলিন নির্গমনকারী কোষগুলো অপসারণ করার পর কুকুরগুলোর দেহে তাদের আবিষ্কৃত এনজাইম প্রয়োগ করেন। আশ্চর্যজনকভাবে কুকুরগুলো ইনসুলিন তৈরিকারী কোষ ছাড়াই স্রেফ ব্যান্টিং ও বেস্টের আবিষ্কৃত এনজাইম তথা কৃত্রিম ইনসুলিনের জোরে প্রায় সত্তর দিন বেঁচে ছিল। অন্যান্য প্রাণীর উপর সফলভাবে পরীক্ষা চালানোর পর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, মানবদেহে প্রয়োগ করা হবে তাদের কৃত্রিম ইনসুলিন।
ব্যান্টিং এবং বেস্টের আবিষ্কৃত ইনসুলিন প্রথমবারের মতো মানবদেহে প্রয়োগ করা হয় ১৯২২ সালে। চৌদ্দ বছর বয়সী কানাডিয়ান শিশু লিওনার্দ থম্পসন ডায়াবেটিসের উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হয় টরন্টো হাসপাতালে। ডাক্তাররা তার সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের পর সিদ্ধান্ত নেন, তার দেহে ‘টাইপ-ওয়ান ডায়াবেটিস’ বাসা বেধেছে।
রক্তে বাড়তি গ্লুকোজের সরবরাহ থামাতে তাকে শর্করাজাতীয় খাবার খেতে নিষেধ করা হয়। তাকে প্রায়ই অভুক্ত অবস্থায় রাখা হতো। মাত্র ৩০ কেজির রোগা শরীর নিয়ে থম্পসন যে বেশিদিন বেঁচে থাকতে পারবে না, সেটি সবাই ধারণা করে নিয়েছিল। এরপর ব্যান্টিং ও বেস্টের পরামর্শে তার দেহে সেই ইনজেকশনের মাধ্যমে ইনসুলিন প্রয়োগ করা হয়।
আশ্চর্যজনকভাবে, মাত্র চব্বিশ ঘন্টার ব্যবধানে থম্পসনের দেহে গ্লুকোজের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। সবাই এই ঘটনায় হতবাক হয়ে যান। ইনসুলিনের সফল প্রয়োগের পর থম্পসন বেঁচে ছিল প্রায় সাতাশ বছর পর্যন্ত। এরপর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায় সে।
কৃত্রিম ইনসুলিন প্রয়োগের মাধ্যমে থম্পসনের সুস্থ হওয়ার ঘটনা যখন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, তখন তুমুল আলোচনা শুরু হয়ে যায় চারিদিকে। গণহারে ডায়াবেটিসের রোগীরা ইনসুলিন খুঁজতে থাকেন, যাতে তারাও থম্পসনের মতো সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। ইনসুলিনের তুমুল চাহিদা তৈরি হওয়ায় কিছু ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিকভাবে ইনসুলিন তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়।
১৯২৩ সালে প্রথমবারের মতো ‘এলি লিলি’ নামের ওষুধ উৎপাদনকারী একটি প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিকভাবে বাজারে ইনসুলিন সরবরাহ করে। ১৯৭৮ সালের আগপর্যন্ত ‘সিনথেটিক ইনসুলিন’ প্রস্তুত করা হতো গরু ও শূকরের দেহ থেকে প্রাপ্ত ইনসুলিন থেকে। কিন্তু যেসব ডায়াবেটিস রোগীর অ্যালার্জি রয়েছে, তাদের শরীরে এই প্রাণীজ ইনসুলিন প্রয়োগের ফলে অনেক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
ফলে কৃত্রিম ইনসুলিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিকল্প উৎসের সন্ধান করতে শুরু করে। ১৯৭৮ সালে ই. কোলাই ব্যাকটেরিয়া থেকে ইনসুলিন উৎপাদনে সফলতা পাওয়া যায়। এরপর থেকে ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমেই ইনসুলিন উৎপাদন করা হচ্ছে।
এসডব্লিউ এসএস / ০৯৫০
আপনার মতামত জানানঃ