বাংলাদেশে গণমাধ্যম কিংবা এর কর্মীরা কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে সেটা নিয়ে আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক বেশ পুরনো। এরই মধ্যে দুই বছর ধরে আর্থিক লেনদেনে নজরদারিসহ সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম তীব্র হয়রানির মুখোমুখি হচ্ছেন। ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইন্সটিটিউট (আইপিআই) এক বিবৃতিতে এর নিন্দা জানিয়েছে।
এর শিরোনামে বলা হয়েছে, সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম সরকারের অব্যাহত হয়রানির মুখোমুখি হচ্ছেন। এর নিন্দা জানায় আইপিআই।
এতে বাংলাদেশের নিরপেক্ষ সংবাদ মাধ্যম এবং সাংবাদিকরা মামলা, হয়রান, ভীতি প্রদর্শনের শিকার হচ্ছেন বলে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। বলা হয়, কয়েক বছরে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতায় ক্রমবর্ধমান হারে চাপ বেড়েছে।
আরও বলা হয়, ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা লঙ্ঘন হয়েছে কমপক্ষে ৩০টি। এ বিষয়টি প্রামাণ্য আকারে উপস্থাপন করেছে আইপিআই।
বিবৃতিটি প্রথমে প্রকাশ করা হয়েছিল ১০ই ফেব্রুয়ারি আইপিআই ডট মিডিয়াতে। তবে তা বিবৃতি আকারে আইপিআইয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে ১৭ই ফেব্রুয়ারি।
এতে দুর্নীতিবিরোধী সুপরিচিত সাংবাদিক রোজিনার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ প্রত্যাহারে বাংলাদেশ সরকারের কাছে আহ্বান জানানো হয়েছে।
বলা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে কর্তৃপক্ষকে। জনস্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে রিপোর্ট করা সাংবাদিকদের অধিকারের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে।
কোভিড-১৯ টিকা কেনা নিয়ে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের রিপোর্টের পর এ নিয়ে পুলিশ রিপোর্ট করে। তথ্যপ্রমাণের অভাবে পুলিশের ওই রিপোর্টে রোজিনা ইসলামকে অভিযোগ থেকে মুক্তি দেয়া উচিত বলে সুপারিশ করা হয়।
পুলিশের এই চূড়ান্ত রিপোর্টের সাত মাসেরও বেশি সময় পর ২৩শে জানুয়ারি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব শিব্বির আহমেদ ওসমান ওই রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করে একটি পিটিশন করেন এবং তদন্ত পুনরায় করার দাবি জানান আদালতের কাছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট (সিএমএম) তাৎক্ষণিকভাবে তার সেই আবেদন গ্রহণ করেন।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম। করোনা মহামারিকালে স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধানী রিপোর্টের জন্য তিনি সুপরিচিত।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পরিদর্শনের সময় ২০২১ সালের ১৭ই মে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তখন কর্মকর্তারা দাবি করেন, বাংলাদেশের কোভিড-১৯ টিকা কেনা নিয়ে ডকুমেন্টের ছবি তুলেছেন তার মোবাইল ফোন দিয়ে। আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে আটক দেখানোর আগে বাংলাদেশ সচিবালয়ের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ৬ ঘণ্টা আটকে রাখা হয়।
সেখানে তিনি শারীরিক এবং মৌখিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে রিপোর্টে বলা হয়েছে। তার ফোন, পাসপোর্ট এবং ব্যক্তিগত অন্যান্য জিনিসপত্র জব্দ করে পুলিশ।
পুরস্কার বিজয়ী এই সাংবাদিককে গ্রেপ্তারের কারণে নাগরিক সমাজসহ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংগঠন ঝড়ো সমালোচনা করে। অবশেষে ২০২১ সালের ২৩শে মে জামিনে মুক্তি পান তিনি। এক বছর পর ২০২২ সালের ৩রা জুলাই তার মামলায় একটি চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা দেয় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ।
এতে তাকে বেকসুর খালাস দেয়ার অনুরোধ করা হয়। কারণ তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তাকে সমর্থন করার মতো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি এবং বহুল বিতর্কিত ১৯২৩ অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্টের অধীনে চুরি এবং রাষ্ট্রীয় স্পর্শকাতর ডকুমেন্টের ছবি তোলার অভিযোগ আনা হয়। এ অভিযোগে তার ১৪ বছরের জেল হতে পারে অথবা মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে।
আইপিআই হেড অব এডভোকেসি অ্যামি ব্রুলেতি বলেন, রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক অভিযোগ প্রত্যাহার করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অনুরোধ জানায় আইপিআই। তার বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বহু বছরব্যাপী আইনগত প্রক্রিয়া এবং তাকে হয়রানির ফলে বাংলাদেশের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ওপর শীতল প্রভাব ফেলে।
দেশের নিরপেক্ষ মিডিয়া কী বিস্তৃত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে, এই মামলা তাও তুলে ধরে। যেসব সাংবাদিক সরকারের দুর্নীতি নিয়ে রিপোর্ট করেন, তারা ঝুঁকিতে আছেন। তাদেরকে ভীতি প্রদর্শন এবং কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে কর্তৃপক্ষ ব্যবহার করছে প্রাচীন আইন।
আর্থিক লেনদেন মনিটরিংসহ তীব্র হয়রানির মুখোমুখি রোজিনা ইসলাম ও তার পরিবার। তার সুনাম ক্ষুণ্ণ করতে এবং হয়রান করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অনলাইনে তাকে টার্গেট করেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রমবর্ধমান চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতায়। সেন্সরশিপ এবং নজরদারিসহ অব্যাহত শারীরিক হামলা, হুমকি, আইনি হয়রানি এবং গ্রেপ্তারের মুখোমুখি হচ্ছেন সাংবাদিকরা।
এসডব্লিউএসএস/১৯৩০
আপনার মতামত জানানঃ