জাকির হোসেন
ধর্মীয় উদ্দেশ্যে মাথা ঢেকে রাখা এবং বোরখা পরার রীতি তিনটি আব্রাহামিক ধর্মের (খ্রিস্টান, ইহুদি এবং ইসলাম) পাশাপাশি অন্যান্য ধর্ম ও সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
ইহুদি আইন (হালাচা) অনুসারে, একজন মহিলাকে বিয়ের পর চুল ঢেকে রাখতে হবে। এটি তার স্বামী, পিতা, পুত্র, নাতি- পিতামহ বা ভাই ছাড়া অন্য কোনও পুরুষের উপস্থিতির জন্য প্রযোজ্য। অর্থাৎ, ইহুদি আইনে শুধুমাত্র নিজের ঘর ছাড়া অন্য কোথাও গেলে চুল ঢেকে রাখতে হবে।
পূর্ব খ্রিস্টধর্মের গির্জাগুলির মধ্যে (পূর্ব ক্যাথলিক, পূর্ব অর্থোডক্স এবং পূর্ব লুথারান ঐতিহ্যসহ) চার্চে থাকাকালীন মহিলাদের জন্য তাদের মাথা স্কার্ফ দিয়ে ঢেকে রাখার প্রথা রয়েছে। এটা সাধারণ জনসাধারণের মধ্যেও প্রায় একই রকম। এই রীতির একটি উদাহরণ রাশিয়ান অর্থোডক্স চার্চে দেখা যায়।
কোরান মুসলিম নারী ও পুরুষদের শালীন পোশাক পরার নির্দেশ দেয়। ইসলামে মেয়েরা এবং নারীরা সম্পর্কহীন পুরুষদের কাছ থেকে নিজেদের শালীনতা ও গোপনীয়তা বজায় রাখা জন্য হিজাব ব্যবহার করে। এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ইসলাম অ্যান্ড মুসলিম ওয়ার্ল্ড অনুসারে ইসলামে উল্লেখিত শালীনতা পুরুষ এবং মহিলাদের উভয়েরই “দৃষ্টি, চালচলন, পোশাক এবং যৌনাঙ্গ” এর সাথে সম্পর্কিত।
সনাতন ধর্মের লোকেরাও হিজাব পড়ে। যেমন, ঘুনঘাট (ঘুনঘাট, ঘুংঘটা, ঘোমটা, ওরহনি, ওদানি, লাজ, চুনারি, ঝুঁদ, কুঁধ) হল একটি হেডকাভার বা হেড স্কার্ফ। যা প্রধানত ভারতীয় উপমহাদেশে পরিধান করা হয়। কিছু বিবাহিত হিন্দু, জৈন এবং শিখ মহিলারা পাতলা শাড়িতে মাথা এবং মুখ আবৃত রাখে।
হিজাব শব্দের অর্থ কি?
হিজাব শব্দের অর্থ “বাঁধা” বা “বিভাজন”।
হিজাব একটি আরবি শব্দ যার অর্থ “বাঁধা” বা “বিভাজন”। ইসলামে অবশ্য এর অর্থ ব্যাপক। এটি পুরুষ ও মহিলা উভয়ের বিনয়ের নীতি, যা পর্দার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। হিজাবের সবচেয়ে দৃশ্যমান রূপ হল মাথার আবরণ, যা অনেক মুসলিম বিবাহিত এবং অবিবাহিত নারীরা পরেন।
হিজাবের ইতিহাস
আজ থেকে ৪৫০০ বছর আগে প্রাচীন ইরাকের মেসোপটেমিয়ায় পর্দাযুক্ত নারী মূর্তি আবিস্কৃত হয়েছে। যা তখনকার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতি প্রতিফলিত হয়। খ্রিস্টপূর্ব ১৩ শতকের দিকে অ্যাসিরিয়ায় নারীদের মাথার আচ্ছাদনগুলির ব্যবহার নিয়ে প্রথম আইন লেখা হয়েছিল। তাদের পাঠ্যের একটি আইনে লেখা ছিলো নারী, কন্যা এবং বিধবারা ধর্মপ্রাণতার চিহ্ন হিসাবে তাদের মাথা ঢেকে রাখতে হবে।তখন নিম্নবিত্ত, দাসী ও পতিতাদের জন্য পর্দা করা প্রয়োজন ছিলোনা- বরং নিষিদ্ধ ছিল।
অর্থাৎ, ৪৫০০ বছর পূর্বে প্রাচীন ইরাকের মূর্তিপূজারী মেসোপটেমিয়ানরা প্রথম পর্দাপ্রথা শুরু করে। যা পরবর্তীতে মিশর, পারস্য, রোম, গ্রিক এবং ভারতে ছড়িয়ে পড়ে।
তখন প্রাচীন মেসোপটেমিয়া, পারস্য, মিশর, বাইজেন্টাইন, গ্রীক সাম্রাজ্যে অভিজাত মহিলারা সম্মান এবং উচ্চ মর্যাদার চিহ্ন হিসাবে পর্দা করতেন।
ইরানের প্রাচীন জরথুস্ট্রিয়ান ধর্মে নারীর হিজাব
মুখ ঢেকে রাখা এবং চুল লুকানো ছিল তখনকার ইরানের সম্ভ্রান্ত মহিলাদের সাধারণ কাজ। যা তাদেরকে নিম্ন শ্রেণীর পরিবার থেকে আলাদা করত। যা তাদের সম্মান এবং উচ্চ মর্যাদার প্রতীক ছিলো। পর্দা সম্পর্কিত তাদের ধর্মের মূল নীতি ছিলো- ‘ভাল চিন্তা, ভাল কাজ এবং ভাল শব্দের ব্যবহার’। এগুলোর সাথে একত্রিত পর্দা নারীকে সতীত্ব ও ধার্মিকতার দিকে আমন্ত্রণ জানাত।
হিজাবের উৎপত্তি জলবায়ুগত
ইসলামের আগে সৌদি আরবে কঠোর জলবায়ু এবং তীব্র তাপের জন্য সবাই শরীর ঢেকে রাখত। এটি ধর্মের সাথে সম্পর্কিত নয় – যা জলবায়ুগত। পরবর্তীতে আরবের মানুষের এই পোষাক ইসলামের সাথে একত্রিত হয়েছে। বর্তমানে এটি মরুসংস্কৃতির পোষাকের মাধ্যমে ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করছে। হাল আমলে এটি একটি সাধারণ ফ্যাশনও বটে। তবে পর্দার নামে পুরুষতন্ত্রের সতিত্ব রক্ষায় এটি সমালোচিত হচ্ছে।
বোরকা কারা আবিস্কার করে?
প্রাচীন কালে বোরকা পারস্য উপসাগরের আরব দেশগুলিতে মহিলাদের দ্বারা পরিধান করা হত। ভারতবর্ষে এটি ১৮ শতকে গুজরাটে উদ্ভূত হয়েছিল বলে মনে করা হয়। এটিকে নেকাবের একটি সাংস্কৃতিক রূপ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বলা হয় যে এটি বয়স্ক ও বিবাহিত মহিলারা বেশি পরে এবং অল্পবয়সী তরুণীরা কম পরে।
হিজাব, নেকাব, বোরকার ক্ষতিকর দিক সমুহ
এসব পর্দার ক্ষেত্রে মেডিক্যাল সায়েয়েন্স এর রিপোর্ট হলো- হিজাব নারীদের মুখে অক্সিজেন ঘাটতি এবং সুর্যের আলো প্রাপ্তির বিঘ্ন ঘটায়। ফলে রক্ত ও মস্তিস্কে অক্সিজেন কম প্রবাহিত হয় এবং শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি তৈরী করে। যা নারীর স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্নক ক্ষতিকর। এ ব্যপারে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেন যে, সমস্ত মহিলারা যেন মিনিস্কার্ট পরে এবং তাদের সমস্ত ধরণের সংক্রমণ ও অন্যান্য অনির্দিষ্ট স্বাস্থ্য সমস্যাগুলির সংবেদনশীলতা এড়াতে “পরিমিত” পোশাক পরে।
সারাজীবন বোরকা পরার প্রবণতা তাদের চোখের ক্ষতি করে এবং সূর্যালোক থেকে ভিটামিন ডি-এর অভাবে ভয়ংকর রোগেও আক্রান্ত হতে পারে। এটা সন্দেহজনক যে, রৌদ্রোজ্জ্বল অঞ্চলের মহিলাদের তাদের পর্দার কারণে উচ্চ মাত্রার ভিটামিন ডি থেকে বঞ্চিত হন এবং ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনে এটি গ্রহন করতে বাধ্য হন।
বোরকা পরে বাইরে হাঁটার সময় এটি বিপজ্জনক হয়ে ওঠতে পারে। কারণ, বোরকার চোখের অংশটি নারীদের দৃষ্টি ক্ষেত্রকে মারাত্মকভাবে সীমাবদ্ধ করে। ফলে তারা তাদের পথ পরিষ্কারভাবে দেখতে পায় না। এছাড়াও, বোরকা শ্রবণশক্তি হ্রাস, ত্বকের সমস্যা, মাথাব্যথা, কার্ডিয়াক ডিসঅর্ডার, হাঁপানি এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
বোরকার সামাজিক সমস্যা
ঘোমটা যৌনতাবাদী। নারী তার শরীরকে ঢেকে রাখার মাধ্যমে সে তাকে পুরুষের ভোগ্যবস্তু হিসেবে তুলে ধরে। এতে যৌনতার প্রতি পুরুষের অতিউৎসাহী চিন্তার উদ্ভব হয় এবং বিকৃত ও হিংস্র আকর্ষণ তৈরী হয়। অপরদিকে উপজাতি নগ্ন সমাজে কোন ধর্ষণ নেই। কারণ, সেখানে ঘোমটার কারণে আলাদা যৌন বিকৃতি হয়না। বোরকা পারিবারিক যৌন নিগ্রহ বন্ধ করতে পারেনা। সমাজে শতকরা ৮৫ ভাগ ছেলে মেয়ে তার নিকট আত্মীয় দ্বারা শিশুকালেই যৌন অভিজ্ঞতার শিকার হয়। যেখানে বোরকা কোন কাজেই আসেনা।
তাছাড়া বোরকা এবং নেকাব পরা নারীরা সমাজে পূর্ণ অংশগ্রহণ করতে পারেনা। সে জনসম্মুখে খেতে পারে না। এতে নারী অন্যদের সহজে শুনতে পায়না এবং মনে রাখার ক্ষেত্রে মুখ ছাড়া অন্যদের ভুলে যায়। লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে এটি একটি বড় বাঁধা।
ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে হিজাব, নেকাব, বোরকা ধর্মীয় প্রতীক। আমাদের উচিত পাবলিক প্লেস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদিতে ধর্মীয় প্রতীক নিরুৎসাহিত করা। যাতে নারী পুরুষের সামাজিক বৈষম্য দূর হয়। নারীর হিজাব পুরুষতন্ত্রের প্রতীক এবং এটি নারীর অধিকার খর্ব করে। তাই আমাদের উচিত এর বিরোধিতা করা।
ইদানিং কিছু ইসলামিক স্কলার হিজাব সম্পর্কে বলেন, নারীর বয়স যতই হোক না কেন পর্দার ব্যপারে “ধর্মে কোনো জবরদস্তি নেই। কাউকে হিজাব পরতে বাধ্য করা উচিত নয়। যে কেউ এটির পরামর্শ দিতে পারে, তবে জবরদস্তি করতে পারেনা। বরং বলতে পারে এটি কীভাবে একটি ভাল জিনিস হয়ে উঠতে পারে। যদিও এটি জনগণের এবং তাদের নিজস্ব ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়।
কোন কোন দেশ বোরকা নিষিদ্ধ করেছে?
বোরকা নিষিদ্ধের তালিকায় তিউনিসিয়া, অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, বুলগেরিয়া, ক্যামেরুন, চাদ, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, গ্যাবন, নেদারল্যান্ডস, চীন, মরক্কো, শ্রীলঙ্কাসহ বর্তমানে ১৬ টি দেশ বোরকা নিষিদ্ধ করেছে। প্রক্রিয়াধীন আছে সুইজারল্যান্ড-ও।
যা-হোক, বোরকা ইসলামের অংশ নয়। কিন্তু মুসলিম সংস্কৃতির একটি উপাদান এবং অন্যান্য ধর্মের নারীদের থেকে পার্থক্য বুঝাতে এটি ইসলামে ব্যবহৃত হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হিজাব
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনী ধর্মের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়। তবে বর্তমান আর্থ-রাজনৈতিক ও আইনি পরিবেশ হিজাবের উপর বিভিন্ন বিধিনিষেধের অনুমতি দিয়েছে। যা মুসলিম মহিলাদের দ্বারা পরিধান করা হয়।
তুরস্কে কি হিজাব নিষিদ্ধ?
ধর্মনিরপেক্ষতার একটি সাংবিধানিক নীতির জন্য তুর্কি সরকার ঐতিহ্যগতভাবে হেড স্কার্ফ পরিধানকারী মহিলাদের পাবলিক সেক্টরে কাজ করা নিষিদ্ধ করেছে। এই নিষেধাজ্ঞা শিক্ষক, আইনজীবী, সংসদ সদস্য এবং রাষ্ট্রীয় প্রাঙ্গনে কর্মরত অন্যান্যদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
ভারতে কি হিজাব নিষিদ্ধ?
ভারতে, যেখানে মুসলমানরা দেশের ১.৪ বিলিয়ন জনসংখ্যার ১৪% হিজাবী। ঐতিহাসিকভাবে ভারতে হিজাব নিষিদ্ধ নয় বা জনসাধারণের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়।
বিভিন্ন দেশে হিজাব নিষিদ্ধ করার কারণ কি?
কিছু গবেষক দাবি করেছেন যে- এই নিষেধাজ্ঞার কারণ হলো, এটি “মুসলিম মেয়েদের মাধ্যমিক শিক্ষা অর্জনকে হ্রাস করে এবং দীর্ঘমেয়াদে শ্রমবাজারে ও পারিবারিক গঠনে তাদের গতিপথকে প্রভাবিত করে”। পাশাপাশি ” উন্নত ও আধুনিক সমাজে মুসলিম মহিলাদের সামাজিক সংহতকরণ হ্রাস করে”।
হিজাব সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কি?
কোরান মুসলিম নারী ও পুরুষদের শালীন পোশাক পরার নির্দেশ দেয়। মুসলিম মহিলারা সম্পর্কহীন পুরুষ থেকে নিজেদের শালীনতা এবং গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্য হিজাব পরে । এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ইসলাম অ্যান্ড মুসলিম ওয়ার্ল্ড অনুসারে, শালীনতা পুরুষ এবং মহিলাদের উভয়ের জন্য প্রযোজ্য। এটি “দৃষ্টি, চালচলন, পোশাক এবং যৌনাঙ্গ” ঢাকার সাথে সম্পর্কিত।
হিজাব পালন মানে কি?
হিজাব পরিধানকারী মহিলাকে মুহাজাবা বলা হয়। মুসলিম নারীদের যাদের সাথে তারা তাত্ত্বিকভাবে বিয়ে করতে পারে সেসব পরুষের সামনে হিজাব পরতে হবে। এর মানে বাবা, ভাই, দাদা, চাচা বা ছোট বাচ্চাদের সামনে হিজাব বাধ্যতামূলক নয়। তাছাড়া একজন মহিলা যার বাইরে কাজ করার প্রয়োজন নেই, বাসা বাড়িতে বেকার, সে পর্দাহীন থাকতে পারে।
ইসলামে পর্দার ইতিহাস কি?
নবী মুহম্মদের অনেক আগে থেকেই আরবে মাথা ঢেকে রাখার চল ছিল। প্রাথমিকভাবে সিরিয়া এবং ইরানের সাথে আরব যোগাযোগের মাধ্যমে ইসলামে পর্দা অঙ্গীভূত হয়। তার কারণ তখন হিজাব ছিল নারীদের সামাজিক মর্যাদার লক্ষণ। সেই সাথে জলবায়ুগত প্রভাব তো আছেই। যা পরবর্তীতে ইসলামের সাথে একত্রিত হয়েছে।
কুরআন কি হিজাবকে বাধ্যতামূলক করে?
এ বিষয়টি বিশ্বের বিভিন্ন আদালত পর্যবেক্ষণ করে বলেছে যে, “পবিত্র কুরআন মুসলিম মহিলাদের জন্য হিজাব বা হেডস্কার্ফ বাধ্যতামূলক করে না। কোরান তার সূরাগুলিতে হিজাব না পরার কারণে নারীদের কোন শাস্তি দেয়না। কুরআনে হিজাব, নেকাব, বোরকা সম্পর্কিত কোনো শব্দ নাই! এ ব্যপারে কোরানে কঠোর কোন দিক নির্দেশনা নাই। দেখুন পর্দা সম্পর্কিত আয়াত…
“হে নবী! আপনার স্ত্রী ও কন্যাদের এবং মুমিন নারীদের বলুন, তারা যেন তাদের গায়ের জামাকাপড় তাদের (বিদেশে অবস্থানকালে) ঢেকে দেয়: এটাই সবচেয়ে সুবিধাজনক, যাতে তারা পরিচিত হয় এবং তাদের শ্লীলতাহানি না হয়।” : কোরান, অধ্যায় ৩৩, আয়াত ৫৯:
এই শব্দগুলোর কোথাও হিজাব, নেকাব, বোরকার কথাগুলি আসেনি।
দেখুন আরো কিছু আয়াত। যেখানে হিজাব, নেকাব, বোরকা সম্পর্কিত কোন শব্দ নাই…
“মুমিন পুরুষদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে, এটি তাদের জন্য অধিকতর পবিত্রতা সৃষ্টি করবে; এবং আল্লাহ তাদের সবকিছু সম্পর্কে জ্ঞাত করি।” – সূরা আন-নূরের ৩০ নং আয়াত
এখানে পর্দার কারণগুলো খুবই নিরীহ ও ধার্মিক বলে মনে হয়। কারণ এখানে হিজাব, নেকাব, বোরকা সম্পর্কিত কোন আয়াত আসেনি।
হিজাব ও বোরকা কি কুরআনে উল্লেখ আছে?
হিজাব ও বোরকা কুরআনে এর কোন উল্লেখ নেই। তবে কোরান শুধুমাত্র একটি শালীন পোশাক পরিধান করার জন্য বলে। মিশর, সিরিয়া এবং তাজিকিস্তানের মতো দেশগুলিতে মুখের পর্দার বিরুদ্ধে প্রবিধান ছিল।তাদের বক্তব্য “বোরকা এবং হিজাব একটি পশ্চাদপসরণমূলক, পুরুষ-শাসিত সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে!
ঐতিহাসিক প্রমাণ থেকে বোঝা যায় যে, ইসলামের শেষ নবীর দ্বারা আরবে পর্দা প্রবর্তন করা হয়নি। সেখানে আগে থেকেই পর্দা ছিল এবং এটি উচ্চ সামাজিক মর্যাদার সাথে এটি যুক্ত ছিল।
কুরআনের সূরা ৩৩:৫৩ তে বলা হয়েছে, “এবং যখন তোমরা [তার স্ত্রীদের] কাছে কিছু চাও, তখন তাদের বিভক্তির আড়াল থেকে জিজ্ঞাসা কর।” এখানে বিভক্তির আড়াল এবং হিজাব, নেকাব, বোরকা সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়।
ইসলামে হিজাব কখন শুরু হয়েছিল?
সপ্তম শতাব্দীর মধ্যে যখন মুহাম্মদ মারা যান এবং ১০ম শতাব্দীর মধ্যে অনেক ইসলামী পণ্ডিত তার শরিয়া আইন ব্যাখ্যা করার এবং এটিকে সম্প্রসারিত মুসলিম সাম্রাজ্যের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ১০ম শতকের দিকে ক্লাসিক শরিয়া আইনের স্বর্ণযুগে হিজাব গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করে।
ইসলামের আবির্ভাবের পর মুহাম্মদের স্ত্রীদের অনুকরণে আরবের নারীরা মাথা ঢাকতেন। মুহাম্মদ এর স্ত্রীদের জন্য নাযিলকৃত কোরান ৩৩:৫৯ এ বলা হয়, মুহাম্মাদকে তার পরিবারের সদস্যদের এবং অন্যান্য মুসলিম নারীদের বাইরে যাওয়ার সময় বাইরের পোশাক পরতে বলা হয়েছে। যাতে তারা হয়রানির শিকার না হয়। সেটা যে হিজাব, নেকাব- সেটা পরিস্কার নয়। হিজাব বাধ্যতামূলক করার পিছনে শরিয়া আইন দায়ি!
বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৫০টি দেশ শরিয়ার কিছু আইন গ্রহণ করেছে। বিশ্বের মাত্র ৮টি দেশে সম্পূর্ণরূপে শরিয়া-ভিত্তিক ফৌজদারি এবং ব্যক্তিগত আইন ব্যবস্থা রয়েছে। যেখানে হিজাব পূর্ণভাবে বা আংশিকভাবে বাধ্যতামূলক।
২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৩২ সালে সৌদি আরব রাজ্যের সৃষ্টির পর থেকে এটি সরকারের স্পষ্ট নীতি যে, দেশটি ইসলামী আইন (শরিয়া) দ্বারা পরিচালিত হবে এবং হিজাব নেকাব বাধ্যতামূলক হবে।
ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানরা নিজেরা আরবের পোশাক না পরলেও তাদের নারীদের তারা আরবের পোশাক পরাতে বাধ্য করে। এটি ধর্মীয় না হলেও ধর্মের নামে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। কেননা, এটি ইসলামপূর্ব যুগ হতে মরুভুমির জলবায়ুগত পোষাক ও সম্মানের প্রতীক। যা পরবর্তীতে ইসলামের সাথে একত্রিত হয়েছে।
আরবে মুসলিম পুরুষরা কি পরিধান করে?
আরবের মুসলিম পুরুষদের পোষাক থাওব নামেও পরিচিত। থাওব বা থোবে হল মুসলিম পুরুষদের পরিধান করা একটি লম্বা পোশাক। আরব দেশগুলিতে প্রচলিত, থোবের উপরের অংশটি শার্টের মতো কাস্টম তৈরি করা হয়, গোড়ালিতে শেষ হয় এবং আলগা হয়। এটি সাধারণত সাদা রঙে তৈরি করা হয়। তবে অন্যান্য রঙেও পাওয়া যায়, বিশেষ করে শীতকালে।
পুরুষরা কি হিজাব পরে?
পুরুষদের হিজাব হল ইরান এবং পারস্য সহ বিশ্বের অন্যান্য অংশে একটি মুসলিম আন্দোলন। যেখানে পুরুষরা তাদের মহিলা আত্মীয় এবং স্ত্রীদের সাথে সংহতি প্রদর্শন হিসাবে হিজাব বা মহিলা হেড স্কার্ফ পরেন। এই আন্দোলন মহিলাদের বাইরে হিজাব না পরার উৎসাহ দেয় এবং এটি পরার প্রয়োজনীয়তাকে শেষ করতে চায়।
বর্তমানে ইরান ও আফগানিস্তানে নারীদের হিজাব পরতে হয় শরিয়া আইনের জন্য। ২০১৮ সাল থেকে সৌদি আরবের নতুন আইন দ্বারা হিজাবের প্রয়োজনীয়া হ্রাস করা হয়েছে। তবে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান বলেছেন, হিজাব হ্রাস করা হলেও অন্যান্য উপসাগরীয় দেশগুলির মতো মহিলাদের এখনও “শালীন এবং সম্মানজনক পোশাক” পরতে হবে।
হিজাব সম্পর্কে ভারত, পাকিস্তান সহ বিশ্বের কিছু দেশে গঠিত আদালতের বক্তব্য
হিজাব বিষয়ে ধর্মীয়গুরু, আলেমদের বক্তব্য পর্যালোচনা করে গঠিত হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চগুলো বলেছে যে, নারীদের হিজাব পরা ইসলামের অপরিহার্য এবং ধর্মীয় অনুশীলন নয়।
কুরআনে কি কোন নির্দিষ্ট ড্রেস কোড আছে?
কোরানে পুরুষ বা মহিলাদের জন্য তাদের গোপনাঙ্গ ঢেকে রাখার বাইরে কোনো পোশাকের কোড নেই। (এবং সেগুলি কী তা নিয়ে কোরানে কোনো অস্পষ্টতা নেই)।
ইসলামের ঐতিহ্যবাহী পোশাক কি?
হিন্দু পুরুষরা প্রায়শই ছোট কোট (আঙ্গারখা) পরেন এবং মহিলারা একটি লম্বা স্কার্ফ বা আলখাল্লা (শাড়ি) পরেন, যেখানে পুরুষ এবং মহিলাদের জন্য সাধারণ মুসলিম পোশাক হল একটি লম্বা সাদা সুতির শার্ট (কুর্তা) এবং ট্রাউজার (পাইজামাহ)।
হজের পোশাক কি ইসলামের পোশাক? যেখানে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাই একই পোশাকে আল্লাহর সামনে হাজির হয়। হজে আসলে নারী-পুরুষ সবাই সমান। হাজী বা তীর্থযাত্রীরা ইহরাম নামক সাদা পোশাক পরেন। হজ্জের সময় তীর্থযাত্রীরা উপাসনা সম্পাদন করে এবং তারা বিশ্বে তাদের উদ্দেশ্যের অনুভূতি পুনর্নবীকরণ করে।
পরিশেষে এতটুকুই বলব, হিজাব নিশ্চিত ভাবেই একটি ইউনিক ‘ইসলামী প্রথা’ নয়। বরং এটা প্রাচীন ইরাক, ইরানি, মিশর, গ্রিক – রোমান প্রথা। পরবর্তী কালে জুদায়ো – খ্রিস্টিয়ান সাংস্কৃতিক প্রথার হাত ধরে আরবে ও ইসলামে গৃহীত হয়েছে। কোনো যৌক্তিক মানুষ এই বিষয়ে আপত্তি করবেন না। কেননা কোন প্রথা আসলে আকাশ থেকে পড়েনা। বরং প্রথা এক সমাজ বা সভ্যতা থেকে আরেক সমাজ বা সভ্যতায় প্রবাহিত হয়।
যারা হিজাব কে ইসলামের প্রথা বলে দাবী করেন এবং একই সাথে ইহুদী নাসারাদের গালিগালাজ করেন, তারা কি এই ধরনের ফাইন্ডিংস এ শরমিন্দা বোধ করবেন?
আর যারা হিজাবকে ‘ইসলামী প্রতীক’ হিসাবে মাথায় ধারণ করেন তারা কি একটু ভেবে দেখবেন কিভাবে আপনি আসলে গ্রিক – রোমান ও জুদায়ো-খ্রিস্টান প্রথাকে মহিমান্বিত করে চলেছেন?
আপনার মতামত জানানঃ