দেশে ধনী গরিবের যে ব্যবধান তা বাংলা সিনেমা কে হার মানিয়েছে বেশ আগে। তবে সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে যে তথ্য প্রকাশ করেছে তা অনেকটাই চমকে দেবে আপনাদের। ক্রেডিট সুইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তৈরি করা ডাটাবেজটির সর্বশেষ প্রকাশিত ২০২২ সালের সংস্করণে দেখা যায়, দেশে এখন ৫০ কোটি ডলার বা ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি পরিমাণের সম্পদ আছে ২১ ব্যক্তির কাছে।
আইন ও সংবিধানের ভিত্তিতে আমানতকারীদের তথ্য সুরক্ষিত ও গোপন রাখতে পারে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলো। যেকোনো অবস্থায়ই ব্যাংকগুলো থেকে আমানতকারীর গোপন তথ্য পাওয়া অসম্ভব। এজন্য বিশ্বের ধনীদের কাছে বৈধ-অবৈধ পন্থায় অর্জিত অর্থ জমা রাখার জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় গন্তব্য সুইজারল্যান্ড। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা গোপন আমানত জমা রাখতে সেখানে গড়ে উঠেছে তিন শতাধিক বেসরকারি ব্যাংক। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ব্যাংকটি হলো ক্রেডিট সুইস। ১৬৬ বছর ধরে ব্যাংকিং কার্যক্রম চালিয়ে আসা প্রতিষ্ঠানটি এখন বিশ্বব্যাপী গোপন অর্থ আমানতের সবচেয়ে বড় গন্তব্যগুলোর একটি।
চমকে যাওয়ার মতো পরিসংখ্যান
ব্যবসায়িক কারণেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সম্পদশালীদের তথ্য সংগ্রহ করে থাকে জুরিখভিত্তিক ব্যাংকটি। প্রায় দেড় দশক ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সম্পদশালীদের পরিসংখ্যান নিয়ে ডাটাবেজ তৈরি করছে প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা উইং, যা প্রকাশ হয় গ্লোবাল ওয়েলথ ডাটাবুক শিরোনামে। ক্রেডিট সুইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তৈরি করা ডাটাবেজটির সর্বশেষ প্রকাশিত ২০২২ সালের সংস্করণে দেখা যায়, দেশে এখন ৫০ কোটি ডলার বা ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি পরিমাণের সম্পদ আছে ২১ ব্যক্তির কাছে। কভিড মহামারীর মধ্যেও ২০২১ সালে দেশে ১০ কোটি টাকার বেশি সম্পদ আছে, এমন ব্যক্তির সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৪৩ শতাংশ। ওই বছরের শেষে দেশে ১ মিলিয়ন ডলার (বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী ১০ কোটি ৭০ লাখ টাকার সমপরিমাণ) বা এর বেশি মূল্যমানের সম্পদের মালিক ছিল ৩০ হাজার ৫৫৯ জন। ২০২০ সালে কভিডের বছরে এ সংখ্যা ছিল ২১ হাজার ৩৯৯ জন।
দেশের অর্থনীতিকে বিপত্তির মুখে ঠেলে দিয়েছিল কভিড মহামারীর প্রাদুর্ভাব। কর্মহীন হয়ে পড়েছিলেন অনেকে। অবনতির দিকে যায় দারিদ্র্য পরিস্থিতি। করোনা প্রাদুর্ভাবের পরের বছর ২০২১ সালটিকে দেখা হচ্ছিল অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের বছর হিসেবে। যদিও এ প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে তুলেছিল কভিডের নতুন ধরনের আবির্ভাব, নতুন সংক্রমণ ঢেউ ও বিধিনিষেধ। পরিস্থিতি আরো সঙ্গিন হয়ে পড়ে বছরের শেষার্ধ্বে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারের অস্থিতিশীলতায়। এসব প্রতিকূলতার মধ্যেও দেশে বিভিন্ন সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর সম্পদ বৃদ্ধি থেমে থাকেনি। বরং এ সময় দেশে অতিধনীদের সংখ্যা আরো দ্রুতগতিতে বেড়েছে।
ডাটাবেজের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সাল শেষে দেশে ৫০ কোটি ডলারের বেশি (৫ হাজার ৩৫০ কোটি টাকার বেশি) সম্পদ ছিল ২১ ব্যক্তির কাছে। এ সময় ১০ থেকে ৫০ কোটি ডলারের (১ হাজার ৭০ কোটি থেকে ৫ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা) সম্পদ ছিল ৪৩ ব্যক্তির। এছাড়া ৫-১০ কোটি ডলারের (৫৩৫ কোটি থেকে ১ হাজার ৭০ কোটি টাকা) সম্পদ ছিল ৩৯ ব্যক্তির হাতে। ৪০০ ব্যক্তির হাতে ছিল ১-৫ কোটি ডলারের (১০৭ কোটি থেকে ৫৩৫ কোটি টাকা) সমপরিমাণ সম্পদ। ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি ডলারের (৫৩ দশমিক ৫ কোটি থেকে ১০৭ কোটি টাকা) সমপরিমাণ সম্পদ ছিল ১ হাজার ১২৫ জনের। ২৮ হাজার ৯৩১ জনের কাছে সম্পদ ছিল ১০ লাখ থেকে ৫০ লাখ ডলারের (১০ কোটি ৭০ লাখ থেকে ৫৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা)।
ক্রেডিট সুইসের ভাষ্যমতে, মূলত নিট উচ্চমূল্যের সম্পদ মালিকদের (হাই নিট ওয়ার্থ ইনডিভিজুয়াল) তথ্য জানতে ডাটাবেজটি নিয়মিতভাবে তৈরি করা হয়। নিট সম্পদের মালিকানার হিসাব করা হয় ব্যক্তির মালিকানাধীন আর্থিক ও অনার্থিক সম্পদের (স্থাবর সম্পদ যেমন জমি, বাড়ি ইত্যাদি) মোট মূল্য থেকে দায়দেনা বাদ দিয়ে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
দুর্নীতিকে মহামারীর মধ্যেও দেশের ধনীদের সম্পদ বৃদ্ধির বড় একটি কারণ হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। বলেন, মানুষের সম্পদের বিকাশ সম্পূর্ণ বৈধ ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় হতে পারে। এখানে সম্পদের বৈষম্য পুঁজিবাদের একটা বৈশিষ্ট্যও বটে।
তার পরও যে বিষয়টি আমাদের মতো দেশে ঘটছে এবং পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও ঘটে, সেটি হলো দুর্নীতি। এর নেতিবাচক প্রভাবগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়ে যায়। আমাদের নীতিকাঠামোটা অনেক ক্ষেত্রেই দুর্নীতিসহায়ক। পৃথিবীর যেসব দেশে সবচেয়ে বেশি হারে উচ্চধনীর সংখ্যা বাড়ছে, তার অন্যতম হলো বাংলাদেশ।
সম্পদের কেন্দ্রীভবনকে বাংলাদেশে সুষম উন্নয়নের পথে অন্তরায় হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, যাদের ধনসম্পদ আছে উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে তাদের সংযোগও বেশি। এ সংযোগ রাজনীতি থেকে শুরু করে আমলাতন্ত্র, ব্যাংক সব পর্যায়ে তাদের প্রভাবশালী করছে। ফলে তারা ব্যাংক ঋণের সুবিধা পায়। ব্যাংক খাতে দেখা যাবে ঋণের বেশির ভাগই কেন্দ্রীভূত বড় গ্রাহকদের মধ্যে।
অঞ্চলভিত্তিক দেখলেও দেখা যাবে চট্টগ্রাম ও ঢাকা ছাড়া বেশির ভাগ এলাকাই বঞ্চিত। আবার আয় বাড়লে ধনীরা জমি-সম্পদ কেনে। প্রয়োজন দুই বিঘা। কিনে রাখে দশ বিঘা। পরে আট বিঘা বিক্রি করে। স্পেকুলেটরি ইনভেস্ট করে। ওদের কাছে সুযোগ ও সম্ভাবনা আছে।
বাংলাদেশে কয়েকটা ক্ষেত্রে মনোপলি-অলিগোপলি আছে। যেমন বিদ্যুৎ, ব্যাংক, ওষুধ—এসব খাতেই কয়েকটা গ্রুপই সবকিছু করছে। অন্যদিকে ক্ষুদ্র-মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলো দিনে দিনে বঞ্চিত হচ্ছে। এটি মোটেও ভালো লক্ষণ না।
কেন বাড়ছে অতিমানবীয় ধনীদের সম্পদ
সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, দেশে অবশ্যই ধনীদের সম্পদের পরিমাণ বাড়ছে। এক্ষেত্রে জবাবদিহিতা, সুশাসন ও রাজনৈতিক অর্থনীতির দিকভ্রান্তির প্রভাব রয়েছে। ফাঁকি দিয়ে হোক, দুর্নীতি করে হোক এ সম্পদ যদি অর্থনীতিতেই থাকত, তাহলে অর্থনীতি অন্তত আরো ৭৫ শতাংশ উপযোগিতা পেত। কারণ মানুষের কর্মসংস্থান হতো। অর্থ দেশেই থাকত এবং দেশেই প্রবাহিত হতো।
এক্ষেত্রে প্রথম অন্যায় যেটি হচ্ছে সেটি হলো ফাঁকি দিয়ে বা দুর্নীতি করে সবার কাছ থেকে সম্পদ কুড়িয়ে নেয়া হচ্ছে। যাদের কাছ থেকে নেয়া হচ্ছে তাদের দিকে না তাকিয়ে বা ফেলে দিয়ে অর্থ নেয়া হচ্ছে বিদেশে। সেখানে সম্পদ গড়ে উঠছে, কর্মসৃজন হচ্ছে, উন্নতি হচ্ছে। এগুলো এখানেই ঘটতে পারত।
এসব কিছুর প্রতিফলন হিসেবে বৈষম্য বাড়ছে। দেখা যাবে যে সংস্কার দেশে প্রয়োজন সেটা এ দুর্নীতিবাজরাই করতে দেবে না। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দুর্নীতিবাজের মামলা সম্পন্ন করতে পারছে না। দেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যদি ঠিকভাবে কাজ করতে পারত তাহলে আজ দেশের এ অবস্থা হয় না।
দেশে অতিধনীর সংখ্যা বাড়লেও আয়করের ৮৫ শতাংশই আসছে পরোক্ষ উৎস থেকে। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে দুর্বল করভিত্তি বাংলাদেশেই। অতিধনীদের বিরাট অংশ দেশে কর না দিয়ে সম্পদ পাচার করছেন ভিনদেশে। অন্য দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করছেন অথবা রেসিডেন্স পারমিট নিচ্ছেন গোল্ডেন ভিসায়। বাংলাদেশ ছাড়াও বিভিন্ন অফশোর গন্তব্যে জমা রাখছেন বিপুল পরিমাণ অর্থ। কানাডা, দুবাই, লন্ডনের প্রাইম লোকেশনে কিনছেন উচ্চমূল্যের বাড়ি। বিদেশী গন্তব্যে অর্থের এ অবৈধ প্রবাহ দেশে বৈদেশিক মুদ্রার ওপরে বড় চাপ তৈরি করেছে।
এসডব্লিউএসএস/১৫৪৫
আপনার মতামত জানানঃ