দীর্ঘদিন ধরেই অস্থিতিশীল বাংলারদেশে চালের বাজার। কোভিডের প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার পর থেকে গত দুই বছরে দেশে চালের দাম ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে। এমনকি প্রতিবেশী ভারতসহ এশিয়ায় চালের অন্যান্য বৃহৎ ভোক্তা দেশের চেয়েও এ বৃদ্ধির হার কয়েক গুণ বেশি।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, এসব দেশের কোনো কোনোটিতে গত দুই বছরে চালের দাম কমেছে। আবার যেসব দেশে বেড়েছে, সেগুলোয়ও এ বৃদ্ধির হার সীমাবদ্ধ ছিল ১০ শতাংশের নিচে, যেখানে বাংলাদেশে প্রধান খাদ্যশস্যটির দাম বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ।
পরিসংখ্যান কী বলে?
এফএও ও ইউএসডিএর তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে বিদায়ী ২০২২ সালের একই সময় পর্যন্ত এশিয়ার ভোক্তা দেশগুলোর মধ্যে থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে এখন পর্যন্ত চালের দাম কমেছে যথাক্রমে ১০ ও প্রায় ১৪ শতাংশ। দাম বেড়েছে ভারত ও পাকিস্তানে। এ দুই দেশে খাদ্যশস্যটির দরবৃদ্ধির হার যথাক্রমে প্রায় ৯ ও ৭ শতাংশ।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের নভেম্বরে রাজধানীর বাজারে প্রতি কেজি মোটা চালের (স্বর্ণা/চায়না/ইরি) দাম ছিল ৪৫-৪৬ টাকা। সেখান থেকে বেড়ে ২০২২-এর নভেম্বরে তা ৫৫ টাকা পর্যন্ত উঠে যায়। সে হিসেবে এ সময়ের ব্যবধানে রাজধানীর বাজারে মোটা চালের দাম বেড়েছে অন্তত ১৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
বাংলাদেশের বাজারে চালের দাম এশিয়ার অন্যান্য স্থানের চেয়ে অনেক বেশি বলে বিভিন্ন সময়ে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। কিছুদিন আগেই এফএওর তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ইউএসডিএ জানায়, প্রতিবেশী ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের বাজারে চালের দাম অন্তত ৭০ শতাংশ বেশি।
মূল্য বৃদ্ধির কারণ কী?
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় প্রায়ই চালের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। বাজারে খাদ্যশস্যটির দাম বারবার অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাওয়ার পেছনে প্রধানত সরকারের দুর্বল মজুদ ব্যবস্থাপনা ও খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততাকে দায়ী করছেন পর্যবেক্ষকরা।
তাদের ভাষ্যমতে, মূলত বিভিন্ন মধ্যস্বত্বভোগীর অনিয়ন্ত্রিত উত্থান, কার্যকর ও দক্ষ সরবরাহ চেইন না থাকা, চালের মজুদ ধারাবাহিকভাবে উচ্চপর্যায়ে না রাখা ও মনিটরিংয়ের অভাবেই চালের বাজারে দাম অসহনীয় পর্যায়ে চলে যেতে দেখা যায়। এ মুহূর্তে বাজারে মনিটরিং বাড়ানোর পাশাপাশি আমদানি ও অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের মাধ্যমে চালের মজুদ ও সরবরাহ বাড়ানোও প্রয়োজন।
চালের বাজারমূল্য বারবার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার পেছনে বাজারের নিয়ন্ত্রণ গুটিকয়েক ব্যক্তির হাতে চলে যাওয়াকে দায়ী করছেন বাজার বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, অর্থায়নসহ নানা বৈষম্যের কারণে বাজারের প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ নষ্ট হয়ে পড়েছে। এর সুবাদে বৃহদায়তনের ব্যবসায়ীরা আরো বড় হয়ে ওঠার সুযোগ পেলেও বহু চালকল মালিক ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন।
সাবেক খাদ্য সচিব আবদুল লতিফ মন্ডল বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে অন্যান্য পণ্যের দাম বাড়লেও চালের দাম কিন্তু খুব একটা বাড়েনি। চালের দাম সাধারণত সবসময়ই কাছাকাছি থাকে। চাল কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো থেকে খুব একটা আসে না। মূলত ভারত, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম থেকেই বেশি আমদানি হয়।
ডলারের ঊর্ধ্বগতি ও আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির ফলে চালের দাম কিছুটা বাড়তে পারে। কিন্তু গত দুই বছরে দেশের বাজারে চালের দাম যে পরিমাণ বেড়েছে তা অস্বাভাবিক। চাল ব্যবসায়ীরা চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করছেন। সিন্ডিকেটের কারণে চালের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। সরকার চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। চাল ব্যবসায়ীরা প্রভাবশালী। ফলে চালের দাম তারাই নিয়ন্ত্রণ করেন। এজন্য সরকারকে বাজার ব্যবস্থাপনায় আরো শক্তিশালী হতে হবে।
গত বছরের আমন মৌসুমে দেশে চালের বেশ ভালো উৎপাদন হয়েছিল। বোরো মৌসুমেও ফলন হয়েছিল ভালো। কিন্তু গত জুনে দেশের উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ভারি বৃষ্টিপাত ও বন্যার কারণে আউশ মৌসুমের আবাদ কমে যায়। আবার একই সময়ে বাজারও মারাত্মক অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি পর্যাপ্ত মজুদ নিশ্চিত করতে জুনে বেসরকারিভাবে চাল আমদানিতে শুল্ক ছাড় দেয় সরকার। এ সময় আমদানি শুল্ক ৬২ দশমিক ৫ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশে নিয়ে আসা হয়। তবু আমদানির পরিমাণ সন্তোষজনক না হওয়ায় আগস্টে চালের শুল্ক আরো কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। কিন্তু বারবার শুল্ক কমানোর পরেও পর্যাপ্ত মাত্রায় চাল আমদানি বাড়ানো যাচ্ছে না ডলারের বিনিময় হারের ঊর্ধ্বমুখিতার কারণে।
এসডব্লিউএসএস/১৫২২
আপনার মতামত জানানঃ