ইরানের এক মুসলিম পরিবারে জন্মেছিলেন মেরি মহম্মদি। পরে তিনি ধর্ম পরিবর্তন করেন। ইসলাম ত্যাগ করে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেন মেরি। তার পর থেকেই দেশের মাটিতে তাঁর জীবন হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইরান ত্যাগ করতে বাধ্য হন মেরি। বর্তমানে বাস করছেন আমেরিকায়। মাহশা আমিনির মৃত্যুর পর ইরানের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ দেখে সংবাদমাধ্যমের কাছে মেরি মুখ খুলেছেন। তাঁকে দেশের মাটিতে কী কী সহ্য করতে হয়েছিল, রাখঢাক না করেই সে সব জানিয়েছেন।
মেরির দাবি, ২০২০ সালে এক বার ঠিক মতো হিজাব না পরার ‘অপরাধে’ তাঁকে আটক করেছিল পুলিশ। রাখা হয়েছিল তেহরানের কাছেই একটি ডিটেনশন সেন্টারে।
সেই ডিটেনশন ক্যাম্পে তাকে পোশাক খুলতে বাধ্য করা হয়েছিল বলে অভিযোগ করেছেন মেরি। যদিও সেখানে সকলেই ছিলেন মহিলা, তবু প্রশাসনের এই ভূমিকার তীব্র নিন্দা করেছেন তিনি।
মেরির অভিযোগ, ইরানে মেয়েদের দমিয়ে রাখার জন্য যৌন হেনস্থার আশ্রয় নেয় প্রশাসন। নানা ভাবে মেয়েদের হুমকি দেওয়া হয়। এটাই ইরান সরকারের প্রতিবাদী স্বর দমনের কৌশল।
ইরানে মুসলমান মেয়েদের সঙ্গে অমুসলমান মেয়েদেরও হিজাব পরতে হয়। দেশের আইন অনুযায়ী তা বাধ্যতামূলক। মেরি ধর্ম পরিবর্তন করার পরও তাঁকে তাই হিজাব পরে মাথা ও শরীরের বাকি অংশ ঢেকে রাখতে হত।
২৪ বছর বয়সি এই ইরানি সমাজকর্মী জানিয়েছেন, ২০১৯ সালে একটি বাসে তেহরান যাচ্ছিলেন তিনি। গরম লাগায় মাথা থেকে হিজাব কিছুটা সরিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কাছে এগিয়ে আসেন এক আদ্যোপান্ত হিজাব পরিহিতা মহিলা। তিনি মেরিকে কাপড় দিয়ে মাথা ঢাকতে বলেন।
কিন্তু অপরিচিত ওই মহিলার কথায় রাজি হননি তরুণী। তিনি বাসেই তার সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে পড়েন। এমনকি ওই মহিলা তাকে আক্রমণ করেন বলেও অভিযোগ। মেরির মুখ কেটে গিয়েছিল। রক্তাক্ত মুখ নিয়ে তিনি থানায় গিয়েছিলেন বিচার চাইতে। কিন্তু অভিযোগ, তাঁর কথায় পুলিশ কান দেয়নি। তাঁর অভিযোগ গ্রহণ করা হয়নি। অভিযুক্ত মহিলাকে ছেড়ে দিয়ে মেরিকে থানায় আটকে রাখা হয়েছিল।
মেরি জানিয়েছেন, ইরানে নীতিপুলিশির বাড়বাড়ন্তে তিনি এবং তার মতো স্বাধীনচেতা মেয়েরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। গোঁড়া মুসলমানরাও মেয়েদের উপর একই ভাবে ছড়ি ঘোরান। ফলে দেশে মেয়েদের স্বাধীন ভাবে বাঁচার পরিবেশই নেই।
২০১৭ সালে ইসলাম ত্যাগ করে মেরি খ্রিস্টান হয়েছিলেন। তার পর থেকেই জীবনের নানা ক্ষেত্রে তাকে বাধার সম্মুখীন হতে হয় বলে অভিযোগ। তার বিশ্ববিদ্যালয় কোনও কারণ ছাড়াই তাঁকে বরখাস্ত করে। ধর্মের কারণে কাজও হারান মেরি।
তিনি জানিয়েছেন, যে স্বাস্থ্যচর্চা কেন্দ্রে তিনি চাকরি করতেন, অতিমারির সময় তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পরে সেখানে আর তাকে ফেরানো হয়নি।
ইরানে মেয়েদের উপর চাপিয়ে দেওয়া এই ধরনের দমনমূলক আইনের বিরুদ্ধে যারা মুখ খোলেন, তাদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলা হয় বলে দাবি করেছেন ‘দেশছাড়া’ মেরি। তিনি জানিয়েছেন, প্রতিবাদীদের উপর যৌন শোষণ ইরানের প্রশাসনের অন্যতম হাতিয়ার।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর ইরানের রাজধানীতে ২২ বছরের তরুণী মাহশা আমিনির মৃত্যু হয়। তার পর থেকে দেশে ক্ষোভের আগুন জ্বলছে। অভিযোগ, হিজাব না পরার অপরাধে তাঁকে আটক করা হয়েছিল। মেরির মতোই তিনিও প্রশাসনের চোখরাঙানির শিকার হয়েছিলেন। পুলিশি হেফাজতেই মাহশার মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ। দেশ জুড়ে তার পর থেকেই বিক্ষোভ শুরু হয়।
মাহশার মৃত্যুর প্রতিবাদে পথে নামেন ইরানের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সাধারণ মানুষ। মেয়েরা প্রকাশ্যে হিজাব পুড়িয়ে, মাথার চুল কেটে ফেলে প্রতিবাদে শামিল হন। আন্দোলনকারীদের উপর ইরান সরকারের নিরাপত্তারক্ষীদের অত্যাচারের খবরও প্রকাশ্যে এসেছে।
মেরির মতে, ইরানবাসীর আর চুপ করে থাকলে চলবে না। ইরানে বিপ্লব প্রয়োজন। মাহশা-কাণ্ডের পর যে আন্দোলন দেশ দেখেছে, তেমন আরও ঝাঁঝালো আন্দোলন ইরানে বিপ্লব ঘটাতে পারবে বলে মনে করেছেন মেরি। একই সঙ্গে মেরির ধারণা, তার দেশের জনগণ জেগে উঠেছে। বিপ্লবের সে দিন আর বেশি দেরি নেই। ইরানের ইতিহাসে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়, মনে করছেন মেরি।
উল্লেখ্য, ইরানের তরুণী মাসা আমিনির মৃত্যুর জেরে বিক্ষোভ আরও জোরদার হচ্ছে। নারীদের নেতৃত্বাধীন এই বিক্ষোভ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী। বিক্ষোভ দমনে তারা গুলি চালাচ্ছে। দেশটির কুর্দিস্তান ও পশ্চিম আজারবাইজান প্রদেশে গতকাল বৃহস্পতিবার বিক্ষোভে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে নিহতের সংখ্যা বেড়ে পাঁচ হয়েছে।
বিক্ষোভে নিরাপত্তা বাহিনীর হামলার ঘটনায় জাতিসংঘ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আর ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক বেসরকারি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।
ইরানের নীতি পুলিশের হেফাজতে গত ১৬ সেপ্টেম্বর মারা যান মাসা আমিনি। এরপর ১৭ সেপ্টেম্বর তাঁর দাফনকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ শুরু হয়। এই বিক্ষোভ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভে এ পর্যন্ত ১০০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছেন। বিক্ষোভে তরুণ-তরুণী নিহত হওয়ায় দেশটির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিক্ষোভ আরও বড় আকার ধারণ করে।
দু’দিন আগে ইরানের রাজধানী তেহরান, বানেহ, মাহবাদসহ বিভিন্ন শহরে বড় বিক্ষোভ হয়। বিক্ষোভের পর গতকাল রাতে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছিল, ওই দিন একজনের মৃত্যু হয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে। সেই নিহতের সংখ্যা আরও বেড়েছে। এর মধ্যে বানেহ শহরে দুজন এবং মাহবাদ শহরে তিনজন নিহত হয়েছেন।
এই বিক্ষোভে নিরাপত্তা বাহিনীর দমন-পীড়ন প্রসঙ্গে ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটের ইরানবিষয়ক বিশেষজ্ঞ হেনরি রোমে বলেন, বিক্ষোভ দমনে সরকার ভয়ংকর পদক্ষেপ নিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এ কারণে বিক্ষোভ আরও জোরদার হয়েছে।
এদিকে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার ইরানের বিভিন্ন শহরে বড় বিক্ষোভ হয়। যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক বেসরকারি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, এই দুই দিনের বিক্ষোভে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে কমপক্ষে আটজন নিহত হয়েছেন। সরকারের এমন পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছে সংগঠনটি।
এই বিক্ষোভ দমন-পীড়নের ঘটনায় আজ শুক্রবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। সংস্থাটির মানবাধিকার কার্যালয়ের মুখপাত্র রাভিনা শামদাসানি বলেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। অনেক বিক্ষোভকারীর পরিবারকে হয়রানি করা হচ্ছে। এমনকি বিক্ষোভে নিহত অনেকের মরদেহ ফেরত দেওয়া হচ্ছে না।’
এসডব্লিউএসএস০৮৪০
আপনার মতামত জানানঃ