প্রতিবছর নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে ভুল চিকিৎসার কারণে ১ কোটি ৩৪ লাখ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ২৬ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। বাংলাদেশেও এমন ঘটনা ঘটছে অহরহ। তবে এর কোনো পরিসংখ্যান নেই।
সম্প্রতি ভুল চিকিৎসার সব দায়িত্ব যেন কাঁধে তুলে নিয়েছে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতাল। গত আগস্টে এ হাসপাতালে এক রোগীর ভুল চিকিৎসা করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে। এরপর সেপ্টেম্বরে অভিযোগ ওঠে এখানে ভুল চিকিৎসায় মারা গেছে এক শিশু। সর্বশেষ ঘটনায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও থানায় অভিযোগ দিয়েছেন মারা যাওয়া শিশুর অভিভাবক। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, তারা কোনো ‘ভুল’ করেননি।
যা ঘটেছিল
গত ১০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় মরিয়ম জামান আরফিয়া নামে আট বছর বয়সী এক শিশু। পরিবারের অভিযোগ, ভুল চিকিৎসায় তার মৃত্যু হয়েছে। যে দুই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে পরিবার অভিযোগ তুলেছে তারা হলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হেমাটোলোজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মনিরুল ইসলাম ও ডা. ইসরাত জাহান লাকি।
মারা যাওয়া শিশু আরফিয়ার মা জোবাইদা আলম বলেন, ডা. মো. মনিরুল ইসলামের পরামর্শে আমি মেয়েকে গত ৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে ভর্তি করি। এরপর সেখান থেকে সকাল ১০টার দিকে ১০ নম্বর ওয়ার্ডে পাঠানো হয়। পরদিন ওয়ার্ড থেকে আমাদের না জানিয়ে পিআইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং এক ঘণ্টা পর আবারও ওয়ার্ডে আনা হয়।
শুরু থেকে আমার মেয়ের থ্যালাসেমিয়া রোগের চিকিৎসা করেননি। তার হিমোগ্লোবিন ৭ দশমিক ১- এ এলেও রক্ত না দিয়ে কেবল টাইফয়েডের ইনজেকশন পুশ করতে থাকেন। সব যখন শেষ তখন তারা আমাদের ডেঙ্গুর কারণে মারা গেছে বলে মিথ্যা ডেথ সার্টিফিকেট দেন
তিনি বলেন, চিকিৎসক মেয়ের ব্লাড ও ইউরিন স্যাম্পল পরীক্ষার জন্য পাঠান। তাকে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছিল। এ সময় ডা. ইসরাত জাহান লাকী এসে তাকে ইনজেকশনের মাধ্যমে হাই পাওয়ারের অ্যান্টিবায়োটিক পুশ করেন। বিকেল ৪টায় ডা. মো. মনিরুল ইসলাম এসে বলেন, মেয়ের টাইফয়েড হয়েছে। এরপর তাকে একের পর এক অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন দিতে থাকেন তারা।
জোবাইদা আলম বলেন, তারা আমাকে প্রথমে বলেন, মেয়ের বুকে ইনফেকশন হয়েছে। আমি এক্স-রে করার জন্য বলি। এক্স-রে রিপোর্ট ভালো আসে। এরপর তারা বলেন, মেয়ের টাইফয়েড হয়েছে। এবার টাইফয়েডের জন্য একাধিক অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশন পুশ করেন।
তিনি বলেন, তারা শুরু থেকে আমার মেয়ের থ্যালাসেমিয়া রোগের চিকিৎসা করেননি। তার হিমোগ্লোবিন ৭ দশমিক ১- এ এলেও রক্ত না দিয়ে কেবল টাইফয়েডের ইনজেকশন পুশ করতে থাকেন। সব যখন শেষ তখন তারা আমাদের ডেঙ্গুর কারণে মারা গেছে বলে মিথ্যা ডেথ সার্টিফিকেট দেন। হাসপাতালে ভর্তির ২ দিন পর ১০ সেপ্টেম্বর ভোরে মারা যায় শিশু আরফিয়া।
মেয়ের মৃত্যুর ঘটনায় রাজধানীর আদাবর থানায় জিডি ও লিখিত অভিযোগ করেছেন জোবাইদা আলম। সেখানে তিনি অভিযোগ করেন, ডা. মনিরুল ইসলামের কাছে নিয়মিত মেয়েকে দেখিয়ে আসলেও হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর তিনি মেয়েটাকে নামমাত্র দেখে যান, গুরুত্ব দিয়ে দেখেননি।
লিখিত অভিযোগে তিনি বলেন, হাসপাতালের লোকদের উদ্দেশ্য ছিল বেশি পরিমাণ অর্থের বিল তৈরি করা। তারা আমাদের অনুমতি ছাড়াই জোর করে বাচ্চার বুকে ইনফেকশন আছে বলে পিআইসিইউতে (শিশুদের জন্য অিািইসিইউ) নিয়ে যায়। অথচ পরে বুকের এক্সরে রিপোর্ট নরমাল আসে। তার মানে পিআইসিইউতে নেওয়া উদ্দেশ্যপূর্ণ ছিল।
তিনি বলেন, পিআইসিইউতে মেয়েকে দেখার জন্য বার বার অনুরোধ করলেও তারা দেখতে দেননি। জোর করে দেখতে চাইলে আমাদের প্রচুর নিয়ম-কানুন দেখান। এমনকি মেয়ে কান্নাকাটি করছে শুনে দেখতে যেতে চাইলে আমাদের বলা হয়, মেয়ে ঘুমাচ্ছে! পরে জোর করে ভেতরে ঢুকে দেখি ঠিকই আমার মেয়ে কাঁদছে, সে পানি খেতে চা্ইছে।
জোবাইদা অভিযোগ করেন, নিজেদের কোনো ভুলের কারণে তারা মেয়েটাকে আর সঠিক চিকিৎসা দেয়নি, কৌশলে তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। এজন্যই তারা মেয়েটাকে আইসিইউতে নিয়ে বন্দি করে রাখে যাতে স্বজনরা কিছু বুঝতে না পারেন। এছাড়া টাকার লোভে তারা মেয়েকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে এক সপ্তাহ রাখারও প্ল্যান করে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
লিখিত অভিযোগে জোবাইদা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আরও যেসব অভিযোগ করেন তার মধ্যে আছে রক্ত না দিয়েও ৪০ হাজার টাকা এ বাবদ খরচ দেখানো।
সবশেষে জোবাইদা লেখেন, দুই চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবহেলা করে, সঠিক সময়ে সঠিক ট্রিটমেন্ট না দিয়ে, ভুল অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে তার মেয়েকে মেরে ফেলেছে। তিনি পুলিশের কাছে এর প্রতিকার চান।
যা বলছেন চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ
মরিয়ম জামান আরফিয়ার মায়ের অভিযোগ অস্বীকার করে অভিযুক্ত চিকিৎসক মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, রোগী ছিল থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। আমাদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে তার বড় ধরনের একটি জ্বর হয়েছিল। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত রোগী রেসপন্স করেনি। শেষ মুহূর্তে কী কারণে তার মৃত্যু হয়েছে, তা আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। তবে ডেঙ্গু সন্দেহ করে আমরা কোয়েরি দিয়ে রেখেছি।
ভুল চিকিৎসার অভিযোগ প্রসঙ্গে এ চিকিৎসক বলেন, ভুল চিকিৎসার বিষয়টি মিথ্যা অপবাদ। কোনো চিকিৎসকই চান না তার রোগী মারা যাক। তাহলে আমরা কেন চাইব? আমরা আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। কিন্তু হায়াত-মউতের মালিক তো আর আমরা নই।
সবশেষ রোগীর প্লাটিলেট কেমন ছিল— জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার যতদূর মনে পড়ে ৮০ হাজারের মতো ছিল। সেখান থেকে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি ব্রেকআপ করার জন্য, কিন্তু রোগী আর রেসপন্স করেনি।
ডেঙ্গু পরীক্ষা করা হয়েছিল কি না— জানতে চাইলে চিকিৎসক মনিরুল বলেন, আমরা বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলাম। কিন্তু এ মুহূর্তে ফাইলটা আমার কাছে নেই। ডেঙ্গু পরীক্ষা করা হয়েছিল কি না বলতে পারছি না।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রসঙ্গে রোগীর মায়ের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শুধু অভিযোগ করলেই তো হবে না, অভিযোগের সত্যতাও আপনাদের খুঁজতে হবে। কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিনি, এটা ভুল কথা।
বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ইঞ্জিনিয়ার এম এ কবির বলেন, বিষয়টি নিয়ে কিছুদিন আগে রোগীর মা আমাদের কাছে একটা লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন। আমরা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করি। তদন্ত কমিটির রিপোর্টে আমরা ভুল চিকিৎসার সত্যতা পাইনি।
তিনি বলেন, তদন্ত কমিটির রিপোর্ট তাকে পাঠিয়েছি। একইসঙ্গে ওই রিপোর্টের মধ্যে আমরা তাকে আমন্ত্রণও জানিয়েছি। তাকে বলেছি, আপনার যদি কোনো কথা থাকে তাহলে এসে বলতে পারেন। এ ছাড়া ওই ঘটনায় আমরা মর্মাহত হয়েছি, তাও উল্লেখ করেছি।
কেন বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না স্পেশালাইজড হাসপাতালের?
বারবার ‘ভুল চিকিৎসার’ অভিযোগ প্রসঙ্গে হাসপাতালটির এমডি এমএ কবির বলেন, সব অভিযোগই মিথ্যা। অধ্যাপক ডা. আরফিন দেশের অন্যতম একজন সেরা চিকিৎসক। চিকিৎসায় তার কোনো ভুল বা গাফিলতি ছিল না। শুধু তিনি নন, যারাই আমাদের হাসপাতালে চিকিৎসা দেন, তারা স্বনামধন্য চিকিৎসক।
তিনি বলেন, আমাদের সমাজে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে যদি কিছু বলা হয়, তাহলে তা খুব বেশি ফলাও করে প্রচার করা হয়। কোনো একটি হাসপাতালে একজন নার্স ঠিকমতো সেবা না দিলে, ব্যবস্থাপনা ঠিকমতো না হলেও দেখা যায় দায় এসে পড়ে চিকিৎসকদের ওপর। সবার মধ্যেই যেন একটা চিকিৎসকবিরোধী মনোভাব কাজ করে। না জেনে না বুঝে কেউ চিকিৎসকদের এভাবে দোষারোপ করতে পারেন না।
তিনি আরও বলেন, আপনি ২০টি ভালো কাজ করবেন, তার জন্য কোনো প্রশংসা পাবেন না। কিন্তু আপনার হাতে একটা দুর্ঘটনা ঘটলে সেটিকে অনেক বড় করে দেখা হবে। সেটা শুধু চিকিৎসকদের ক্ষেত্রেই নয়, যেকোনো ক্ষেত্রেই এমনটি দেখে থাকবেন। সুতরাং দুয়েকটি দুর্ঘটনায় আপনি যদি বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালকে মাপতে চান, তাহলে সেটি হবে ভুল। আমরা এখানে রোগীদের অনেক ভালো চিকিৎসা দিই। তারপরও ছোটখাটো ভুলত্রুটি হতে পারে। সেগুলো আমরা সংশোধন করব।
এসডব্লিউ/এসএস/১১৪৫
আপনার মতামত জানানঃ