হঠাৎ করে আওয়ামী লীগ কেন বিএনপির ওপর বেশ মারমুখী হয়ে উঠেছে; এই প্রশ্ন এখন উঠেছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে বিরোধীদল বিএনপি যতগুলো রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করেছে, দলটির নেতারা বলছেন যে তার বেশির ভাগই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হামলার শিকার হয়েছে। বিএনপির নেতারা আরও অভিযোগ করছেন, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েই বিরোধীদলের আন্দোলন দমনের চেষ্টা করছে।
বিরোধীদল বিএনপির নেতাকর্মীদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষের সর্বশেষ ঘটনা ঘটে মুন্সীগঞ্জে গত বুধবার। এর কয়েকদিন আগে ঢাকার বনানী এবং মিরপুর এলাকায় বিএনপির কর্মসূচি পণ্ড হয় এবং দুটো ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দিকে অভিযোগের তীর তোলা হয়।
গত এক মাসে বিশটির বেশি জেলায় বিএনপির কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগ হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ বিরোধীদলটির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেছেন, সাধারণত পুলিশের পক্ষ থেকে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব দেখানো হলেও এখন আওয়ামী লীগ মারমুখী হয়ে বিএনপির আন্দোলন দমন করতে চাইছে।
“আজকে যখন জনগণ মৌলিক দাবিগুলো নিয়ে পথে নামছে, তখন মরিয়া হয়ে তারা (ক্ষমতাসীন সরকার) কখনও আওয়ামী লীগকে এবং কখনওবা পুলিশকে ব্যবহার করছে।”
যা বলছে আওয়ামী লীগ
টানা ১৫ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিকভাবে অনেকটা বিপর্যস্ত বিএনপি এবার নির্বাচনের আগে রাজপথে থাকার চেষ্টা করছে। দলটি সরাসরি আওয়ামী লীগ সরকারের পতন বা পদত্যাগের দাবিও তুলছে। বিএনপির এই অবস্থানের কারণে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মাঝে বেশি প্রতিক্রিয়া হয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
সেজন্য সাম্প্রতিক সময়ে জেলা-উপজেলা এবং এমনকি ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত বিএনপির কর্মসূচিতে হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে তাদের ধারনা। মুন্সীগঞ্জ, রাজশাহী, যশোরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীর সাথে কথা বলেও এমন ধারণা পাওয়া গেছে।
তাদের বক্তব্য হচ্ছে, এখন বিএনপির কর্মসূচিগুলোতে দলটির সবপর্যায়ের নেতারা মূলত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টার্গেট করে ‘অসম্মানজনক বক্তব্য’ দিয়ে থাকেন। সেজন্য অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগের মাঠের নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভের প্রকাশ ঘটছে।
বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে আওয়ামী লীগের একজন নেত্রী জিনাত সোহানা চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন যে তাদের কাছে বিএনপিকে এখন আগের চেয়েও বেশি আক্রমণাত্নক মনে হচ্ছে এবং এই বিষয়টি আওয়ামী লীগের মাঠের নেতাকর্মীদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশের পেছনে বড় একটি কারণ।
নিজের দাবির পক্ষে যুক্তি দিয়ে জিনাত সোহানা চৌধুরী বলেন, “তাদের (বিএনপির) প্রতিটা কর্মসূচিতে কিন্তু ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে এবং এলাকা রণক্ষেত্র হয়ে যায়। সাধারণ মানুষের জানমালের ক্ষতিও হয়।
“আপনি যখন পুলিশের ওপর ইটপাটকেল ছুঁড়বেন, তখন পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি ছাঁড়তে বাধ্য হবে। তারা (বিএনপি) অন্যায়ভাবে আন্দোলন করে মানুষের জানমালের ক্ষতি করলে অবশ্যই আমরা প্রতিহত করবো।”
প্রধানমন্ত্রীর দ্বিমুখী আচারণ
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি দেয়া এক বক্তব্যে জানিয়েছিলেন যে তিনি বিরোধীদলের কর্মসূচিতে বাধা না দেয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন।
এরপরও বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষের ওপর হামলার ঘটনা নিয়ে সমালোচনার মুখে মাত্র কয়েকদিন আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলীয় নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক সংঘর্ষে না জড়ানোর নির্দেশনা দেন।
তবে তার কাছ থেকে কিছুটা ভিন্ন বক্তব্য আসে অতি দ্রুতই। পরের দিনই তিনি আবার বলেন, “মাঠ কারও কাছে ইজারা দেয়া হয়নি। আমরা মাঠ ছেড়ে যাইনি।” এখন আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনগুলোও বিএনপির কর্মসূচির পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামছে।
গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ভোলা এবং নারায়ণগঞ্জে পুলিশের সাথে বিএনপির নেতাকর্মীদের সংঘর্ষে তিনজন নিহত হওয়ার ঘটনায় পুলিশকে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিল।
এরপর থেকে পুলিশের চেয়ে বরং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদেরকেই বিভিন্ন জায়গায় বিএনপির ওপর মারমুখী হতে দেখা যায়।
চ্যালেঞ্জের মুখে আওয়ামী লীগ
আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন একটি ধারনা পাওয়া যাচ্ছে যে নির্বাচনের আগে নানা দিক বিবেচনায় দলটির নেতৃত্ব এখনই বিএনপিকে চাপে ফেলতে চাইছে।
কৃষিমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, নৈরাজ্যকর কোন পরিস্থিতি সৃষ্টির আগে এখনই সে ধরনের চেষ্টা থামাতে হবে বলে তারা মনে করছেন।
২০১৪ সালের নির্বাচনের সময় এবং তার পরের বছর বিএনপির আন্দোলন যে সহিংস রূপ নিয়েছিল, সেই উদাহরণ টানেন এই সিনিয়র নেতা।
তিনি বলেন, এর আগেও তারা (বিএনপি) আন্দোলন করেছিল। তারা তখন সন্ত্রাসের পথে গিয়েছিল। এখন আবার সে রকম একটা অরাজকতা এবং নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। এটা তো বাড়তে দেয়া যাবে না।
এমন অবস্থান নেয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ড. রাজ্জাক আরও বলেন, “রক্তক্ষয় হলে মানুষ আমাদের পক্ষে থাকবে না। আমি তো ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, গুলি করে যদি তাদের দমন করতে হয়, তাতে মানুষ আমাদের পক্ষে থাকবে না। কাজেই এটা আমরা চাই না। দেশে স্থিতিশীলতা রাখতে হবে।”
আওয়ামী লীগ নেতাদের কেউ কেউ দাবি করেন যে লম্বা একটানা শাসনে রাজনৈতিকভাবে তাদের দল বড় কোন চ্যালেঞ্জে পড়েনি। তবে এবার বিএনপির মাঠে থাকার অব্যাহত চেষ্টা এক ধরণের চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে, আওয়ামী লীগের অনেক নেতা তেমনটা মনে করেন।
ফলে বিরোধীদলকে চাপে রাখার কৌশলের নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা থাকলেও আওয়ামী লীগ সেই পথেই হাটবে বলেই পরিস্কার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
বিশ্লেষকরা যা বলছেন
লেখক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, এই বিরোধ আরও বাড়বে।
তার যুক্তি হলো, আওয়ামী লীগ মোটামুটি ধরে নিয়েছে যে বিএনপি মুখে যাই বলুক, তারা নির্বাচন করবে এবং নির্বাচন করার জন্য তারা সিরিয়াস। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির সভা-সমাবেশগুলোতে প্রচুর মানুষের উপস্থিতির বিষয়টিও এক্ষেত্রে একটা ভূমিকা রাখছে বলেও তিনি মনে করেন।
“যেখানেই তারা (বিএনপি) অল্প সময়ের ঘোষণায় মিটিং করে, সেখানে কিন্তু অনেক লোকজন হয়। এতে আওয়ামী লীগ কিছুটা বেসামাল অবস্থায় পড়ে গেছে। সব দিক বিচার করলে মনে হয়, এই সমস্যা বা বিরোধ আগামীতে আরও বাড়বে।”
আওয়ামী লীগ সরকার একদিকে মানবাধিকার ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের চাপে রয়েছে। অন্যদিকে ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে বিশ্বে জ্বালানি সঙ্কটের প্রভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ অর্থনৈতিক বিভিন্ন ইস্যুতে চাপে পড়ছে দেশের ভেতরে।
এমন পটভূমিতে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের অনেকে মনে করেন, সরকার বিরোধী কর্মসূচিতে রাজপথে মানুষের সমর্থন বাড়তে পারে।
আওয়ামী লীগের একাধিক সিনিয়র নেতা এমন ধারনাও করছেন যে বিএনপি ঢাকায় প্রতিদিন জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশ করবে এবং তাতে লোকসমাগমও বাড়বে। তবে সেই সুযোগ তারা দিতে চান না।
এছাড়া, বিএনপি রাজপথে অবস্থান শক্ত করে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে- এমন আলোচনাও রয়েছে আওয়ামী লীগের ভেতরে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৪২০
আপনার মতামত জানানঃ