আমাদের দেশে মধ্যবিত্তদের কাছে একটু ভালো মানের জুতা মানেই বাটা। দেশের প্রায় প্রতিটি শহর বাজারে রয়েছে বাটার শোরুম। তবে এটি আমাদের দেশের কোনো ব্র্যান্ড নয়। এমনকি বাটার কোনো জুতাও তৈরি হতো না এদেশে। সময়ের সাথে সাথে ধীরে ধীরে বাহারি ডিজাইন আর টেকসই হওয়ার কারণে নারী-পুরুষ সবার কাছেই আজ পছন্দের এই জুতা।
বাটার কার্যালয় সুদূর সুইজারল্যান্ডের লুসানে। এটি একটি বহুজাতিক জুতা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। ৫০টিরও অধিক দেশে বাটা কোম্পানির শাখা রয়েছে। ২৬টি দেশে রয়েছে বাটার জুতা তৈরির কারখানা। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাটা কোম্পানি ১৪ বিলিয়নেরও অধিক জুতা বিক্রি করেছে। বাটা কোম্পানি ১৮৯৪ সালে তদানিন্তন অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের যলিন শহরে প্রতিষ্ঠিত হয়। যেটি এখন চেক প্রজাতন্ত্রের অন্তর্গত।
বাটার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন টোমাস বাটা। তার নামানুসারেই কোম্পানির নাম হয় বাটা। টোমাস বাটার পরিবার ছিল মুচির পেশায় নিয়োজিত। তার বাবা, দাদা এমনকি পূর্বপুরুষের একমাত্র পেশা ছিল জুতা সেলাই ও তৈরি করা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সেনাবাহিনীর জন্য জুতা তৈরি করে বাটা কোম্পানির ব্যবসার প্রসার ঘটে। পাইকারী হারে জুতা নির্মাণের ক্ষেত্রে বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান হিসাবে বাটা ছিল অগ্রদূত।
টোমাস বাটা তার সমাজ সচেতনতার জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। তিনি তার কর্মীদের জন্য বাসস্থান, সিনেমা হলসহ বিভিন্ন সেবার ব্যবস্থা করেন। টোমাস বাটাকে এই কারণে অনেক সময় ‘পূর্ব ইউরোপের হেনরি ফোর্ড’ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
১৯৩২ সালে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে এক বিমান দূর্ঘটনায় টোমাস বাটা যলিন বিমানবন্দরে মারা যান। তার সৎভাই জ্যান আন্টোনিন বাটা এই কোম্পানির দায়িত্ব নেন। সে সময় বাটা কোম্পানিতে নিযুক্ত ছিল ১৬ হাজার ৫৬০ জন কর্মী আর ২৭টি কারখানা। এর প্রায় সবটাই ছিল বোহেমিয়া-মোরাভিয়া এলাকায়।
সে সময় ওই এলাকায় তাদের দোকান ছিল প্রায় ১৫০০ আর কারখানা ২৫টি। সেখানে কাজ করত ১৫ হাজার ৭৭০ জন কর্মী। স্লোভাকিয়ায় ছিল ২৫০ জন কর্মী ও ২টি কারখানা। এর বাইরে সারা বিশ্ব জুড়ে বাটার ২০টি কারখানা, ১৩২টি দোকান এবং ৭৯০ জন কর্মী ছিল। জ্যান আন্টোনিন বাটার অধীনে বাটা কোম্পানির দ্রুত প্রসার ঘটে।
ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, এশিয়া, এবং উত্তর আফ্রিকা মহাদেশ জুড়ে বাটার জুতা জনপ্রিয় হয়ে উঠে। এসময় বাটা কোম্পানির সদর দফতর ও সর্ববৃহৎ স্থাপনা ছিল যলিন শহরেই। জুতা উৎপাদন ছাড়াও বাটা কোম্পানি টায়ার, খেলনা, ও প্লাস্টিকের তন্তুও উৎপাদন শুরু করে।
১৯৩০ এর দশকে জ্যান বাটা বোহেমিয়া ও মোরাভিয়া এলাকার কারখানা ও দোকানপাটের সংখ্যা বৃদ্ধি করেন। আগের চাইতে দ্বিগুণ হয়ে কর্মীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৮ হাজারে, আর ২২০০টি দোকান ও ৭০টি কারখানা এই এলাকায় চালু হয়। স্লোভাকিয়াতে ২৫০ জন কর্মী থেকে বেড়ে মোট কর্মীর সংখ্যা হয় ১২ হাজার ৩৪০ আর কারখানার সংখ্যা হয় আটটি।
৩০ এর দশকে বিশ্বজুড়ে মন্দা দেখা দেয়। তা সত্ত্বেও জ্যান বাটা চেকোস্লোভাকিয়া ও বিশ্বজুড়ে তার ব্যবসার আকার প্রায় ছয় গুণ বাড়ান। ১৯৩২ থেকে ১৯৪২ এর মধ্যে বাটা কোম্পানির মোট কর্মীর সংখ্যা বেড়ে হয় এক লাখ পাঁচ হাজার ৭৭০ জন। ১৯৩০ এর দশকে ইউরোপের অর্থনৈতিক মন্দার কারণে চেকোস্লোভাকিয়াতে উৎপাদিত জুতা বিদেশে রফতানি করা ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে। এরপর ব্রাজিল, ব্রিটেন, ও কানাডাতে বাটার কারখানা ও শাখা চালু করা হয়।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে বাটা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখন করে আছে। বাংলাদেশে পরিচালিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বাটা বাংলাদেশ সরকারকে সর্বোচ্চ কর প্রদান করে থাকে। তার অংকটা ৭০ শতাংশের কোঠায়। ২০০৯ সালের হিসাব মতে, বাটা কর্তৃক প্রদত্ত করের পরিমাণ প্রায় এক দশমিক দুই বিলিয়ন। বছরে ৩০ মিলিয়ন জুতা বিক্রয় হয় এবং বাৎসরিক টার্নওভার প্রায় পাঁচ বিলিয়ন টাকা।
আমাদের দেশেও রয়েছে সুদূর চেক প্রজাতন্ত্রের ফ্যাক্টরি। বাটা জুতার ফ্যাক্টরিটি টঙ্গী এবং ধামরাইয়ে অবস্থিত। এখানে প্রতিদিন এক লাখ ১০ হাজার জোড়া জুতা প্রস্তুত করা হয়। এছাড়াও এদের নিজস্ব ট্যানারি শিল্প রয়েছে। এখানে বছরে পাঁচ মিলিয়ন বর্গফুট চামড়া উৎপাদিত হয়। ফ্যাক্টরিটি পরিবেশ বান্ধব, এখানে স্টেট অব দি আর্ট টেকনোলজি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়।
এই চামড়া দিয়েই তৈরি হয় বাটার জুতা, ব্যাগসহ নানা পণ্য। বাটা যে শুধু জুতার কোম্পানি, তাই ই নয়, বিভিন্ন দেশের সামাজিক কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করে। এদেশেও খেলাধুলাকে উৎসাহিত করতে এটি বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত খেলায় স্পন্সরশীপ দিয়ে থাকে।
এছাড়াও এই কোম্পানি দেশের বিকলাঙ্গ মানুষকে আর্থিক সহায়তা, দারিদ্র বিমোচন কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ, মেধাবী এবং বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ধরণের সহায়তা প্রদান করে। সেই সঙ্গে জাতীয় দূর্যোগে দরিদ্র এবং অবহেলিত মানুষকে সহায়তা প্রদান করে থাকে। এসবই তাদের কার্যালয়ের একটি ফান্ড থেকে দেওয়া হয়। এসব সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ড সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক অর্গানাইজেশন এবং বাটা ফাউন্ডেশেন কর্তৃক পরিচালিত।
এই কোম্পানি শিশুদের নিয়েও কাজ করে। বিশেষ করে তাদের ভরন-পোষণ, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এবং ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করতে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করে থাকে। দরিদ্র এবং মেধাবী শিক্ষার্থীদের বাটা বিভিন্ন আর্থিক সহযোগীতা ছাড়া এর পণ্য বিনামূল্যে প্রদান করে থাকে। এটি পথশিশুদের পূনর্বাসন এবং তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যপক কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮২২
আপনার মতামত জানানঃ