দেশে দিন যতো যাচ্ছে করোনার টিকার প্রতি মানুষের অনাগ্রহ ততো বাড়ছে। টিকা গ্রহণে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে যদিও সরকার নানা কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে তবু টিকা গ্রহণে আগ্রহ নেই মানুষের। ফলে নষ্ট হচ্ছে সরকারের লাখ লাখ করোনার টিকা। অপচয় হতে চলেছে মজুদ টিকার একটি বড় অংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, এপর্যন্ত সরকার মোট ৩০ কোটি ডোজ টিকা সংগ্রহ করেছে। এখনও মজুত আছে এক কোটি ৪৮ লাখ ডোজ।
সরকারের লক্ষ্য ছিলো ১৩ কোটি ২৯ লাখ প্রাপ্ত বয়স্ককে টিকা দেয়ার। এর মধ্যে প্রথম ডোজ নিয়েছেন ১২ কোটি ৯৭ লাখ মানুষ। ৩২ লাখ মানুষ এখনো প্রথম ডোজ নেননি। আর দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ১২ কোটি মানুষ। দ্বিতীয় ডোজ নেননি ৯৭ লাখ মানুষ। সব মিলিয়ে এক কোটি ২৬ লাখ মানুষ প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ টিকার বাইরে আছেন। আর ছয় কোটিরও বেশি মানুষের বুস্টার ডোজের সময় হলেও তারা নিচ্ছেন না।
এই হিসাব ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের বাদ দিয়ে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক কোটি ৭৩ লাখ প্রথম ডোজ নিয়েছে। দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছে এক কোটি ৬১ লাখ শিক্ষার্থী। সরকার চলতি মাসে পাঁচ থেকে ১১ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের টিকা দেয়া শুরু করবে। টিকা পাবে চার কোটি ২০ লাখ শিশু।
নভেম্বরের পর প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার টিকা থাকবে না বলে সতর্ক করে দিয়েছেন সরকারের টিকা ব্যবস্থাপনা টাস্কফোর্স কমিটির সদস্য সচিব ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর ডা. শামসুল হক। তিনি বলেন, নভেম্বরের পর শুধু বুস্টার ডোজের টিকাই হাতে থাকবে। তখন প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজের টিকা হাতে থাকবে না। যারা প্রথম ডোজ নেননি, তারা এখনই প্রথম ডোজ নিয়ে নেবেন। এক মাস পরে তারা দ্বিতীয় ডোজ পাবেন। আর যারা দ্বিতীয় ডোজও গ্রহণ করেননি, তারা অবশ্যই এখনই দ্বিতীয় ডোজ নিয়ে নেবেন। কারণ দিন দিন আমাদের টিকার মজুদ কমে আসছে।
ডা. শামসুল হক বলেন, সব মানুষ যাতে টিকা পান, সে জন্য আমরা এই টিকা সংগ্রহ করেছি। টিকা দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যাগও নেওয়া হয়েছে। আমাদের হাসপাতালগুলো প্রস্তুত করা হয়েছে। টিকা কেন্দ্র প্রস্তুত আছে। এই ৩২ লাখ প্রথম ডোজ ও দ্বিতীয় ডোজের ৯৭ লাখ মানুষ, যারা এখনো টিকা নেননি তাদের জন্য যে টিকাগুলো মজুদ আছে, সেগুলোর মেয়াদ নভেম্বর পর্যন্ত। নভেম্বরে এই টিকার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে।
এই কর্মকর্তা আরও বলেন, বর্তমানে আমাদের প্রত্যেকটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসব টিকা কার্যক্রম চলমান আছে। যেকোনো জায়গায় রেজিস্ট্রেশন করে টিকা নিতে পারবেন। যার রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ নেই, তিনি টিকা কার্ড বা এনআইডির মাধ্যমে টিকা নিতে পারবেন।
টিকা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে এই কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশে টিকা কার্যক্রমের কারণে সংক্রমণ হার অনেক কম। এখনো বিশ্বের অনেক দেশে প্রতিদিন প্রচুর মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। সম্প্রতি জাপানে প্রায় দুই লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশে টিকাগ্রহীতার হার বেশি হওয়াতে, যারা টিকা নিয়েছেন, তাদের সংক্রমণ যেমন কম হচ্ছে; তেমনি সংক্রমণ যাদের হচ্ছে, তাদের মারাত্মক হচ্ছে না। জটিলতা অনেক কম হচ্ছে। সে কারণে হাসপাতালে এখন ভর্তির হারও অনেক কম। মৃত্যুর হারও অনেক কম। এ জন্য আমি বিশেষভাবে বলতে চাই, যারা টিকা গ্রহণ করেননি, তারা যেন অবশ্যই টিকাটা নিয়ে নেন।
ডয়েচেভেলের প্রতিবেদনে জানা যায়, ঢাকায় কয়েকটি করোনা টিকাদান কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এখন মানুষের মধ্যে টিকা নেয়ার আগ্রহ তেমন নেই। এমনকি বুস্টার ডোজেও আগ্রহ নেই।
আগে তো টিকার জন্য লম্বা লাইন পড়ে যেত। এখন আর তেমন কেউ টিকা নিতে আসেন না। বুস্টার ডোজেও আগ্রহ নেই।
ঢাকার শ্যামালিতে বিশেষায়িত যক্ষা হাসপাতাল করোনার টিকার একটি বড় সেন্টার। এই হাসপাতালে টিকার দায়িত্বে আছেন সহকারী পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার। তিনি ডয়েচেভেলেকে বলেন,”আগে তো টিকার জন্য লম্বা লাইন পড়ে যেত। এখন আর তেমন কেউ টিকা নিতে আসেন না। বুস্টার ডোজেও আগ্রহ নেই। আমরা সম্প্রতি সাত দিনের ক্যাম্পেইন করেছি। তাতে প্রত্যন্ত অঞ্চলে কিছু মানুষ টিকা নিয়েছেন। এখন আবার ভাটা পড়েছে। ”
তিনি জানান,” প্রত্যেক ভ্যাকসিনের একটি মেয়াদ থাকে। আমরা আমাদের চাহিদা মত ভ্যাকসিন আনার পর যা আমাদের কাছে থাকে তা মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই অন্য কোনো কেন্দ্রে প্রয়োজন হলে পাঠিয়ে দেই। আমরা প্রতি সপ্তাহে ভিডিও কনফারেন্স করি। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে কোনো কেন্দ্রই তারা বরাদ্দের টিকা শেষ করতে পারছে না। তবে আমাদের কোনা টিকা এখনো নষ্ট হয়নি। অক্টোবরে মেয়াদ শেষ হবে বলে ইপিআই থেকে আমাদের জানানো হয়েছে।”
মানুষের মধ্যে আগ্রহ কম কেনজানতে চাইলে তিনি বলেন,”কেউ কেউ মনে করছেন হয়তো এগুলোর এখন আর দরকার নেই।”
এরইমধ্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে টিকার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমা নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তারা প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজের টিকা সবাইকে দিতে চাইছেন । ডা. মো. শামসুল হক বলেন,”সরকার নাগরিকদের জন্য প্রতিটি টিকা পাঁচ ডলার খরচ করে কিনেছে। এখন সেই টিকা পচে যাচ্ছে। সেপ্টেম্বরের পর কেউ এসে কান্নাকাটি করলেও আমরা টিকা দিতে পারব না। মাথা ঘুরে পড়ে গেলেও না। নতুন ক্যাম্পেইনের সাথে বুস্টার ডোজও দেয়া হবে। আর যার যখন বুস্টার ডোজের সময় হবে তখন পাবেন। কিন্তু তাতেও তো তো আগ্রহ দেখছি না।”
তিনি বলেন,” আমরা গণমাধ্যমে বার বার বলছি তারপরও মানুষ টিকা নিচ্ছে না। আমরা কী করব? সরকারের দায়িত্ব ছিলো টিকা আনার। সরকার এনেছে। এখন আপনার দায়িত্ব টিকা নেয়ার আপনি নিন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী অচিরেই প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজের টিকা দেয়া কবে বন্ধ হবে তারা ঘোষণা দেবেন।”
তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন.” টিকার ক্যাম্পেইনে শুরু থেকেই ত্রুটি ছিলো। আর যে ক্যাম্পেইন চালানো হয়েছে তাতে নতুনত্ব নেই। ফলে মানুষের কাছে একঘেয়ে মনে হয়েছে। মানুষ যখন দেখলো টিকা নেয়ার পরও করোনা হয়, বুস্টার ডোজ নেয়ার পরও করোনা হয় তখন কেউ কেউ মনে করল , টিকা নিয়ে কী হবে। কিন্তু টিকা দেয়া থাকলে যে সংক্রমণের তীব্রতা কম হয় সেটা ব্যাপকভাবে প্রচার করা হলো না। আবার জনপ্রতিনিধিদের এই টিকায় কেন জানি সম্পৃক্ত করা হলো না। সেটা করা হলে আরো বেশি মানুষ টিকা নিত।”
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০২৬
আপনার মতামত জানানঃ