সংবিধানমতে, শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ তথা কর্মসূচি পালন করার অধিকার প্রতিটি দল ও সংগঠনের আছে। অথচ আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হলো যখন যারা ক্ষমতায় থাকে, তখন তারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে থাকে কথিত আইনশৃঙ্খলার দোহাই দিয়ে।
আওয়ামী লীগের নেতারা এত দিন অভিযোগ করতেন যে বিএনপি জনজীবনের সমস্যা নিয়ে কথা বলে না, তারা আন্দোলন করে কেবল দলীয় প্রধানের মুক্তির দাবিতে। অথচ বিদ্যুৎ ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে আনার দাবিতে বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠন যখন কর্মসূচি নিল, তখন হামলা, মামলা ও গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটল।
ভোলা সদর উপজেলায় পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষে গুলিতে একজন নিহত হয়েছেন। সংঘর্ষে আহত হয়েছেন দুই পক্ষের অর্ধশতাধিক ব্যক্তি। আজ রোববার বেলা ১১টার দিকে জেলা সদরের মহাজনপট্টিতে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
বিদ্যুৎ ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে আনার দাবিতে বিএনপির ডাকা বিক্ষোভ সমাবেশে এ সংঘর্ষ হয়। নিহত ব্যক্তির নাম মো. আবদুর রহিম। তিনি সদর উপজেলার দক্ষিণ দিঘলদি ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা।
বিএনপির দাবি, পুলিশ অতর্কিতভাবে তাদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে বাধা দিয়ে গুলি চালিয়েছে। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সমাবেশের অনুমতি নিয়ে মিছিল বের করায় পুলিশ বাধা দিলে বিএনপি নেতা-কর্মীরা তাদের ওপর চড়াও হয়।
ভোলা জেলা বিএনপির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আমিনুল ইসলাম খান আজ দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, জেলা সদরের মহাজনপট্টিতে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করছিলেন দলের নেতা-কর্মীরা। এ সময় ঘটনাস্থলে এসে বাধা দেয় পুলিশ। তাঁরা প্রতিবাদ জানালে পুলিশ লাঠিপেটা শুরু করে। এরপর দুই পক্ষের সংঘর্ষ বাধে। পুলিশের ছোড়া গুলিতে তাঁদের এক কর্মী নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৪৫ জন।
জেলা পুলিশ সুপার মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, বিএনপির সমাবেশ করার অনুমতি ছিল, কিন্তু মিছিলের অনুমতি ছিল না। বিএনপি মিছিল বের করে পুলিশের ওপর চড়াও হয়। তাদের কাছেও অস্ত্র ছিল। আবদুর রহিম নামের লোকটি মারা গেছেন। তবে তিনি কার গুলিতে মারা গেছেন তদন্ত না করে বলা সম্ভব নয়। এ ঘটনায় পুলিশের আট সদস্য আহত হয়েছেন।
এর আগে গত মার্চে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনগুলো ১১ দিনব্যাপী কর্মসূচি পালন করেছে, যা গত ২৬ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়েছে এবং ১৪ মার্চ শেষ হয়। তাদের কর্মসূচির মধ্যে ছিল রাজধানী ঢাকার পাশাপাশি সব বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা সদরে বিক্ষোভ সমাবেশ।
কিন্তু অনেক স্থানে বিএনপির কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হতে পারেনি পুলিশের বাধার কারণে। অন্যদিকে অনেক স্থানে ক্ষমতাসীন দলের একশ্রেণির নেতা-কর্মী বিএনপির সমাবেশে হামলা চালায়। কোথাও কোথাও তাদের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ হয়।
পত্রিকার খবর অনুযায়ী, পটুয়াখালী সদর, দুমকি, পিরোজপুর, নাটোর, ঝিনাইদহ, লালমনিরহাট, নোয়াখালী, শরীয়তপুর, বগুড়া, মৌলভীবাজার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রভৃতি জেলায় হামলার ঘটনায় বহু নেতা-কর্মী আহত হন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব বিরোধী দলের সভা-সমাবেশ ভেঙে দেওয়া নয়; কোথাও কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে যাতে বিশৃঙ্খলা না ঘটে, তা দেখা। আমরা আরও লক্ষ করেছি যেসব স্থানে বিএনপির নেতা-কর্মীদের শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া হয়েছে, সেসব স্থানে কোনো সমস্যা হয়নি। কর্মসূচি পালনের পর নেতা-কর্মীরা ঘরে ফিরে গেছেন।
যেসব স্থানে পুলিশ বাধা দিয়েছে, ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা হামলা চালিয়েছেন, সেখানেই অঘটন ঘটেছে। জনজীবনের সমস্যা নিয়ে ক্ষমতাসীন দল ও এর সহযোগীদের কর্মসূচি নিতে দেখা যায় না। কিন্তু বিরোধী দল কোনো কর্মসূচি নিলে তারা বাধা দেওয়াকে তাদের ‘নৈতিক দায়িত্ব’ বলে মনে করেন।
গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত সবার সমানাধিকার। কিন্তু আমরা কী দেখছি? বিরোধী দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতে গিয়ে বারবারই প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। গণতন্ত্রের জন্য তা মোটেও কল্যাণকর নয়।
বিভিন্ন দল রাজনৈতিক কর্মসূচি দেবে, সুস্থ ধারার রাজনীতি চর্চা করবে- এটিই তো প্রত্যাশিত। কিন্তু আমরা যখন দেখি রাজনীতির নামে অপরাজনীতি কিংবা নানা রকম কদর্যতা সৃষ্টি হচ্ছে রাজনীতিকদেরই কারও কারও কারণে, তখন আশাহত না হয়ে পারি না। গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা প্রায় সর্বজনীন। গণতন্ত্র শুধু নির্দিষ্ট সময়ান্তে নির্বাচনের ব্যাপার নয়, গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতির ব্যাপার। প্রশ্ন হচ্ছে- রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক করবে কে এবং কীভাবে, সমাজে যদি গণতান্ত্রিক চেতনা ও মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা না ঘটে? প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য রাষ্ট্রের ওপর সমগ্র সমাজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন।
জনগণ ও গণতন্ত্রের প্রতি ন্যূনতম দায়বদ্ধতা ও শ্রদ্ধাবোধ থাকলে কোনো রাজনৈতিক দল বা তাদের সহযোগী সংগঠন এ ধরনের কাজ করতে পারে না। ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক দলের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে বাধা দেওয়া হবে না, সেই নিশ্চয়তা দিতে হবে সরকারকেই।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬৬০
আপনার মতামত জানানঃ