ঊর্ধ্বগামী জনসংখ্যা, বাড়ছে বেকারত্ব। এই অবস্থায় ক’দিন আগে ভারতের জনবিস্ফোরণ নিয়ে হুঁশিয়ারি দিয়েছিল রাষ্ট্রসংঘ। সেই সময় বলা হয়েছিল, ২০২৭ সালের মধ্যে চীনকে ছাপিয়ে যাবে ভারতের জনসংখ্যা। যদিও রাষ্ট্রসংঘের সাম্প্রতিক সমীক্ষা অন্য কথা বলল। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, আগামী ৭৮ বছরে ভারতের জনসংখ্যা কমবে ৪১ কোটি। দেশে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মত দিয়েছেন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা। সার্বিক প্রজনন ক্ষমতা কমার জন্যেই যে জনসংখ্যা কমবে, তাও বলা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, ভারতের জনসংখ্যার এই ব্যাপক সঙ্কোচন কোনো প্রতিষেধক নয়। বরং গবেষকদের মতে, কোনো দেশের জনসংখ্যার বৃদ্ধি নেতিবাচক হয়ে গেলে সেই দেশের জ্ঞান এবং জীবনযাত্রার মানও স্থবির হয়ে যায়। ধীরে ধীরে অবলুপ্তির দিকে এগিয়ে যায় ওই জনগোষ্ঠী।
জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিভাগের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে ভারতের জনসংখ্যা প্রায় ১৪১.২ কোটি। ২১০০ সালে তা কমে ১০০.৩ কোটিতে নেমে আসবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। ফলে সামনের বছরগুলোতে ভারতের জনসংখ্যার ঘনত্বও উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে। ভারত ও চীনের জনসংখ্যা বর্তমানে প্রায় সমান।
তবে জনঘনত্বের ক্ষেত্রে দুই দেশের বিশাল পার্থক্য রয়েছে। ভারতে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে গড়ে ৪৭৬ জন মানুষ বাস করেন। সেখানে চীনে প্রতি বর্গ কিলোমিটারের গড় জনসংখ্যা মাত্র ১৪৮ জন। ২১০০ সাল নাগাদ ভারতের জনঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৩৩৫ জনে নেমে আসবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। ভারতের জনঘনত্বের এই পতন, সামগ্রিকভাবে বিশ্বের জনঘনত্বের পতনের থেকে অনেকটাই বেশি হবে বলেই মনে করছেন গবেষকরা।
কিন্তু জনসংখ্যা এবং জনঘনত্বের এই ব্যাপক হ্রাসের কারণ কি? স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের দাবি—এর একমাত্র কারণ ভারতের প্রজনন হার কমে যাওয়ার কারণেই জনসংখ্যা ও জনঘনত্বও ক্রমে কমবে। বর্তমানে ভারতের প্রজনন হার নারী প্রতি ১.৭৬ জন।
অর্থাৎ প্রতি মহিলা পিছু ১.৭৬ জন শিশু জন্ম নিচ্ছে। ২০৩২ সালে এই প্রজনন হার কমে ১.৩৯-এ দাঁড়াবে বলে অনুমান করছেন বিজ্ঞানীরা। একইভাবে কমতে কমতে ২০৫২ সালে প্রজনন হার হবে ১.২৮, ২০৮২ সালে ১.২ এবং ২১০০ সালে আরও কমে গিয়ে দাঁড়াবে নারী প্রতি ১.১৯-এ।
তবে শুধু ভারতেই নয়, প্রজনন হার কমার এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সহ বিশ্বের প্রায় সবগুলো দেশেই। ভারতের সঙ্গে সঙ্গে আগামী শতকে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই ক্রমে জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব কমবে বলে মনে করা হচ্ছে।
জাতিসংঘের ধারণা, ২১০০ সালে চীনের জনসংখ্যায় আশ্চর্যজনক পতন দেখা যাবে। বর্তমান জনসংখ্যা থেকে ৯৩.২ কোটি কমে গিয়ে শি জিনপিংয়ের দেশের জনসংখ্যা সেই সময় দাঁড়াতে পারে মাত্র ৪৯.৪ কোটিতে। বিশ্বের ক্ষেত্রেও জনসংখ্যা ও জনঘনত্বের এই পতনের কারণ উর্বরতার হার বা প্রজনন হার কমে যাওয়া।
উল্লেখ্য, ভারতে প্রজননের হার আগের তুলনায় কমেছে। তবে সবচেয়ে বেশি কমেছে মুসলিমদের মধ্যে। কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় ফ্যিমিলি হেলথ সার্ভিস-এর রিপোর্ট এই কথাই বলছে।
জাতীয় ফ্যামিলি হেলথ সার্ভিস (এনএফএইচএস) ৫-এর তথ্য বলছে, ২০১৫-১৬ সালে প্রজননের হার ছিল দুই দশমিক ছয়। ২০১৯-২১ সালে এই হার কমে দাঁড়িয়েছে দুই দশমিক তিন-এ।
সব ধর্মের মানুষের মধ্যেই প্রজননের হার কমেছে, তবে মুসলিমদের মধ্যে তা সবচেয়ে বেশি কমেছে। ১৯৯২-৯৩ সালে মুসলিমদের মধ্যে প্রজননের হার ছিল চার দশমিক চার, এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে দুই দশমিক তিন-এ। তবে ভারতে সব ধর্মের মানুষের মধ্যে মুসলিমদের প্রজননের হার এখনো সবচেয়ে বেশি। হিন্দুদের মধ্যে প্রজনেনর হার হলো এক দশমিক ৯৪। ২০১৫-১৬তে তা ছিল দুই দশমিক এক। ১৯৯২-৯৩ সালে হিন্দুদের প্রজননের হার ছিল তিন দশমিক তিন।
এনএফএইচএসের পরিসংখ্যান বলছে, ক্রিশ্চানদের প্রজননের হার এক দশমিক ৮৮, শিখদের এক দশমিক ৬১, জৈনদের এক দশমিক ছয় এবং বৌদ্ধদের এক দশমিক ৩৯।
গবেষকদের মতে, ২০৫০ সালের মধ্যে গোটা বিশ্বেরই গড় প্রজনন হার ০.৫-এর নিচে নেমে যেতে পারে। অর্থাৎ প্রতি দুই জন নারী প্রতি জন্ম নিতে পারে মাত্র একটি করে শিশু।
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় বলা হয়েছে, কোনো দেশ যত ধনী হয়, ততই সেই দেশের প্রজনন হার কমতে থাকে। এর ফলে সেই দেশের জনসংখ্যা স্থির থাকে না। বরং, জনসংখ্যার ক্রমে কমতে থাকে। তবে বিশ্বের জনসংখ্যার এই ক্রমহ্রাসমান প্রবণতার পুরো উল্টো পথে হাঁটতে পারে আফ্রিকার দেশগুলো।
জাতিসংঘের মতে, কঙ্গো, মিশর, ইথিওপিয়া এবং নাইজেরিয়ার মতো দেশগুলোতে ২১০০ সাল পর্যন্ত জনসংখ্যার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা রয়েছে। বিশ্বের বেশিরভাগ অঞ্চলের বিপরীতে এই জনসংখ্যা বৃদ্ধিকর ফলে চলতি শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে চালনা করতে পারে আফ্রিকার দেশগুলো, এমনটাও অনুমান করছেন গবেষকরা। অন্তত, আফ্রিকার দেশগুলোর সামনে সুযোগের একটা নতুন জানালা খুলে যেতে পারে।
পাশাপাশি আর একটা দিক ভেবে দেখা যায়। বিশ্বজুড়ে কমছে পুরুষের প্রজনন ক্ষমতা৷ অনেকেই এর জন্য দায়ী করছেন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাড়তে থাকা তাপমাত্রাকে৷
২০১৭ সালের একটি গবেষণা বলছে, ১৯৭৩ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে পুরুষের প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশের কাছাকাছি৷ ‘লো স্পার্ম কাউন্ট’ বা অক্ষম শুক্রাণুর সমস্যার কারণ হিসাবে সেখানেও দেখানো হয়েছে পারিপার্শ্বিক প্রাকৃতিক পরিবর্তন ও জীবন যাপনের ধারাকে৷
পুরুষের স্বাভাবিক প্রজনন ক্ষমতার ওপর চারপাশের পরিবেশের প্রভাব নিয়ে আলোচনা দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে৷ খ্যাতনামা ব্রিটিশ শেফ গর্ডন র্যামসে এই সমস্যা নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন বহু আগেই৷
দীর্ঘক্ষণ কোলে ল্যাপটপ রাখলে, সাওনাতে বেশি সময় কাটালে বা গরম হতে থাকা মোবাইল ফোন পকেটে বেশিক্ষণ রাখলে কমতে পারে পুরুষের শুক্রাণু উৎপাদন ক্ষমতা৷এমন তথ্যই উঠে এসেছে সাম্পতিক একটি গবেষণা থেকে৷
একই গবেষণা থেকে জানা গেছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পৃথিবীজুড়ে বাড়ছে তাপমাত্রা৷ ফলে, একদিকে বাড়ন্ত গরম, আরেক দিকে ল্যাপটপ-মোবাইল-সাওনা’র অত্যধিক ব্যবহারের ফলে কমছে পুরুষের প্রজনন ক্ষমতা৷ হয়ত একদিন এভাবেই লুপ্ত হয়ে যেতে পারে গোটা মানব প্রজাতি৷
এসডব্লিউ/এসএস/২০৫৩
আপনার মতামত জানানঃ