শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে পদত্যাগের ঘোষণার কথা প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহেকে অবহিত করেছেন বলে জানিয়েছে তার কার্যালয়। সোমবার শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এই খবর নিশ্চিত করা হয়েছে। হাজার হাজার বিক্ষোভকারী দুই নেতার বাসভবনে ঢুকে পড়ার পর এই ঘোষণা এসেছে। যদিও একটি পক্ষ এখানে নতুন ষড়যন্ত্রের আভাস পাচ্ছে।
এদিকে, দেশটিতে প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচন আগামী মার্চের আগেই অনুষ্ঠিত হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। গত শনিবার বিকেলে সিনিয়র একটি রাজনৈতিক সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে বলে রোববার খবর দিয়েছে শ্রীলঙ্কার জনপ্রিয় ইংরেজি দৈনিক ডেইলি মিরর।
অপ্রতিরোধ্য সাধারণ মানুষ
গত ৩১ মার্চ বিক্ষোভকারীরা শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত বাসভবনে প্রবেশের চেষ্টা করলে তিনি প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবনে ওঠেন। গত শনিবার বিক্ষোভকারীরা সরকারি বাসভবনে প্রবেশ করার আগেই তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে যান।
ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি সরকারি সূত্রের বরাতে জানিয়েছে, ৭৩ বছর বয়সী গোটাবায়া রাজাপাকসে নৌবাহিনীর কর্মকর্তাদের পাহারায় পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যান। তাকে একটি নৌকায় করে সরিয়ে নেওয়া হয়। নৌকাটি দ্বীপের উত্তর-পূর্ব দিকে চলে যায়।
এদিকে, শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসের বাড়িতে পাওয়া প্রায় ৫০ হাজার ডলারের সমপরিমাণ অর্থ আদালতে জমা দিয়েছে পুলিশ। বিক্ষোভকারীরা শনিবার প্রেসিডেন্টের বাসভবনে ঢুকে পড়ার পর এসব নগদ অর্থের সন্ধান পায়। পরে সেগুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। সোমবার পুলিশ সেগুলো আদালতে জমা দিয়েছে। এখন এর মালিকানা নিয়ে আইনি লড়াই চলবে।
বিক্ষোভকারীরা শনিবার প্রেসিডেন্টের বাসভবনে ঢুকে প্রায় এক কোটি ৭৮ লাখ শ্রীলঙ্কান রুপির (প্রায় ৫০ হাজার ডলার) সন্ধান পায়। নতুন নোটের এসব অর্থ পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
সোমবার পুলিশের এক মুখপাত্র বলেন, ‘এসব অর্থ পুলিশ গ্রহণ করেছে আর আজ এগুলো আদালতে জমা দেওয়া হবে’। রাষ্ট্রীয় ওই ভবন থেকে স্যুটকেস ভর্তি নথিও পাওয়া গেছে বলেও জানা গেছে।
আজ সোমবার শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় শহর কলম্বো শান্ত রয়েছে। হাজার হাজার মানুষ প্রেসিডেন্টের বাসভবন, কার্যালয়ে অবস্থান করছেন। উপনিবেশিক আমলের ভবনগুলো ঘুরে দেখছেন তারা। তাদের থামানোর কোনও চেষ্টাই করছে না পুলিশ।
এদিকে, আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করার আগ পর্যন্ত তাদের বাসভবন দখলে রাখা হবে বলে জানিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা।
গত শনিবার পার্লামেন্টের স্পিকারের ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ১৩ জুলাই পদত্যাগ করার কথা জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে। তবে প্রেসিডেন্ট নিজে কোনও ঘোষণা দেননি, এমনকি তাকে প্রকাশ্যে কোথাও দেখা যায়নি।
সামরিক সূত্রের বরাত দিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট বর্তমানে নৌবাহিনীর একটি জাহাজে শ্রীলঙ্কার সমুদ্রসীমায় অবস্থান করছেন। তার ভাই ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসেও বর্তমানে একটি নৌঘাটিতে অবস্থান করছেন বলে জানিয়েছে সংবাদমাধ্যমটি।
এদিকে, বিক্ষোভকারীরা এখনও প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় আস্থা রাখতে পারছেন না। ছাত্র বিক্ষোভের এক নেতা লাহিরু ভিরাসেকারা বলেন, ‘আমাদের সংগ্রাম শেষ হয়নি। আমরা এই সংগ্রাম তখন পর্যন্ত ছাড়বো না যতক্ষণ (প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে) আসলেই সরে না যান’।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও মানবাধিকার আইনজীবী ভবানি ফনসেকা বলেন, রাজনৈতিকভাবে কী ঘটছে তা দেখার জন্য আগামী কয়েক দিন চরম অনিশ্চিত সময় হতে চলেছে। তিনি বলেন, দুই নেতা সত্যিই পদত্যাগ করেন কিনা তা দেখাটা খুবই চমৎকার বিষয় হবে।
শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে রবিবার আরও বৈঠক চালিয়েছেন রাজনৈতিক নেতারা। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন বলেছেন, নতুন যেকোনও সরকারের অবিলম্বে দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক স্থিতিশীলতার ওপর নজর দিতে হবে’।
শ্রীলঙ্কা কি সেনা শাসনের দিকে এগোচ্ছে?
যদিও কলম্বোবাসীর অনেকেই মনে করছেন, পদত্যাগের ঘোষণার পিছনে গোটাবায়ার অন্য কৌশল আছে। দেশকে সেনা শাসনের দিকে ঠেলে দেওয়া তারই চাল হতে পারে। কারণ, দ্বীপরাষ্ট্রের সেনা বাহিনীর প্রতিটি স্তরে রাজাপাকসে পরিবারের ঘনিষ্ঠরা রাজ করছে।
বিগত ১৭ বছরের মধ্যে ১৩ বছর এই পরিবারের হাতেই ক্ষমতা ছিল। আর প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে গোটাবায়া ছিলেন সামরিক সচিব।
বর্তমান সেনা প্রধান সাভেন্দ্রা সিলভা গতকাল বাহিনীর শীর্ষকর্তাদের পাশে বসিয়ে সাংবাদিক বৈঠক করে দেশবাসীকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। আশ্বাস দিয়েছেন, স্বাভাবিক অবস্থা ফেরাতে সেনা তাদের কর্তব্য করবে। শুধু দেশবাসীকে নয়, সেনাপ্রধান বিদেশি দূতাবাসগুলির মাধ্যমে বাকি দুনিয়াকেও বার্তা দিয়েছেন, সেনা বাহিনী সতর্ক আছে। পরিস্থিতি হাতের বাইরে যেতে দেবে না সেনা।
সাভেন্দ্রা সিলভা রাজাপাকসে পরিবারের লোক। তার বিরুদ্ধে মানবাধিকার হরণের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। তিনি প্রেসিডেন্টের এতই কাছের মানুষ যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সিলভার বিরুদ্ধে জাফনায় বসবাসকারী তামিলদের উপর অত্যাচার চালানোর অভিযোগে বিধিনিষেধ আরোপ করা সত্ত্বেও গোতাবায়ে বা তার দাদা মাহিন্দা রাজাপাকসে সেনা প্রধানকে সরাননি।
কেন মনে করা হচ্ছে, সেনা শাসনের দিকে দেশকে ঠেলে দেওয়া রাজাপাকসে পরিবারের চাল হতে পারে? বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শ্রীলঙ্কায় বিগত কয়েক মাস যাবৎ কার্যত সেনা শাসন চলছে। সাধারণ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে অবসরপ্রাপ্ত অথবা কর্মরত সেনা অফিসারদের বসিয়ে দিয়েছেন গোতাবায়া। অনুগত সেনা ক্ষমতায় থাকলে রাজাপাকসে পরিবার কাগজে কলমে কিছুদিন দেশ শাসন করতে পারবে। রক্ষা পাবে তাদের বিশাল সম্পত্তি।
লক্ষণীয় হল, গত কয়েকদিন যাবৎ সেনা খুব একটা মারমুখী হয়নি। যদিও মে মাসেই দেখামাত্র গুলি করার ক্ষমতা সেনাকে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া পুলিশ-সহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সেনাকেও কাজ করার অধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ দখলকারীদের সেনা বাধা দেয়নি। কলম্বো অভিমুখে নাগরিক মিছিল আটকাতে সাধারণ প্রশাসন কার্ফু জারি করেছিল। আদালত এবং মানবাধিকার কমিশন তা বাতিল করে দেয়।
মনে করা হচ্ছে, এর পিছনে সেনার ভূমিকা আছে। কারণ, শ্রীলঙ্কায় আদালত এবং মানবাধিকার কমিশনের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক অতীতে বারে বারেই সেনার কথায় চলার অভিযোগ ওঠে। সেনা চাইলে কার্ফু বলবৎ রেখে বিদ্রোহী জনতাকে দমনের পথে হাঁটতে পারত।
কিন্তু অনেকেই মনে করছেন, এই অস্থিরতা চলতে দেওয়ার পিছনে আছে নাগরিকদের ক্ষোভ প্রকাশের সুযোগ দেওয়াও। এই সুযোগে সেনার পক্ষে ক্ষমতা দখল সহজ। অভ্যন্তরীণ বিবাদ শুরুর পর থেকেই শ্রীলঙ্কা পুলিশ সেনার সঙ্গে কথা বলে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে সিদ্ধান্ত করছে। কার্যত রয়েছে যৌথ বাহিনীর হাতে। শ্রীলঙ্কা পুলিশের আইজি সিডি বিক্রমরত্নে আজ দেশবাসীকে বলেছেন, শান্তিপূর্ণভাবে মৌলিক অধিকার প্রয়োগ করুন। শান্তিভঙ্গ করবেন না।
শ্রীলঙ্কার সংবিধান অনুযায়ী, প্রেসিডেন্টকে অপসারণ অত্যন্ত কঠিন। অপসারণের প্রস্তাব প্রথমে সংসদে পাশ করাতে হয়। সংসদ অপসারণের প্রস্তাবে সায় দিয়ে তা সুপ্রিম কোর্টের কাছে যাবে। সর্বোচ্চ আদালত অপসারণের কারণের সঙ্গে সহমত হলে ফের সেই প্রস্তাব সংসদে পাশ করাতে হয়। শ্রীলঙ্কার সংসদে বর্তমানে শাসক দলের পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। আদালতেও গিজ গিজ করছে রাজাপাকসে পরিবারের ঘনিষ্ঠ বৃত্তের লোকেরা।
সেনার ক্ষমতা দখলের সম্ভাবনা নিয়ে জল্পনার কারণ, গোতাবায়ে গোপন ডেরায় বসে আরও কিছুদিন ক্ষমতা ধরে রাখতে পারতেন। আবার বিরোধী দলও চলতি পরিস্থিতিতে দেশের ভার নিতে তেমন আগ্রহী নয়। এমন পরিস্থিতিতে সর্বদলীয় সরকার হলেও সেই সরকারকে সেনার কথায় চলতে হবে বলে অনেকের ধারণা। যেমনটা হয়েছে অতীতে বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং পাকিস্তানে অন্তর্বর্তী ও স্থায়ী, সব সরকারের সময়েই।
এসডব্লিউ/এসএস/২০৩৩
আপনার মতামত জানানঃ