টানা কয়েকদিন ধরে লাগাতার ভারী বর্ষণ হচ্ছে সিলেটে। উজানে ভারতের বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকায় বর্ষণ হচ্ছে। এতে করে সিলেটে ফের বাড়ছে বন্যার পানি।
এরই মধ্যে সিলেটের ১৩টি উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। সুরমা, কুশিয়ারা ও সারি নদীর পানি চারটি পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। সিলেট নগরে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করার কারণে নগরের নদী তীরবর্তী কয়েকটি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে করে মানুষের মধ্যে দুর্ভোগ বেড়েছে।
এমন অবস্থায় বন্যার পানিতে আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধারে কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলায় সেনাবাহিনী নামানো হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেট সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ আজ শুক্রবার সকাল ছয়টার তথ্য অনুযায়ী, সুরমা নদীর দুটি ও কুশিয়ারা নদীর একটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া সারি নদের একটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার অন্যান্য নদ-নদীর পানিও ক্রমশ বাড়ছে বলে পাউবোর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
বানভাসি মানুষেরা জানিয়েছেন, বন্যার পানি বেড়ে যাওয়ায় অনেকে বাড়িঘরে আটকা পড়েছেন। তারা এ অবস্থা থেকে উদ্ধার চান। এ ছাড়া অনেক বন্যার্ত খাবার ও পানির সংকটে সবচেয়ে বেশি পড়েছেন। ঘরে হাঁটু থেকে গলাসমান পানি ওঠায় অনেকে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন। অনেকে ত্রাণও পাচ্ছেন না। এতে তৈরি হয়েছে চরম মানবিক বিপর্যয়। পানি যত বাড়ছে, সংকটও তত বাড়ছে।
স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও বন্যাকবলিত মানুষেরা জানিয়েছেন, সিলেট নগরের অন্তত ২০টি এলাকার পাশাপাশি জেলার কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, সদর, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও দক্ষিণ সুরমা উপজেলার ছয় শতাধিক গ্রাম বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এতে কমপক্ষে ১০ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। এসব এলাকায় বেড়েছে জোঁক, সাপ ও পোকামাকড়ের উপদ্রব। চলাচলের জন্য মিলছে না নৌকা। ফলে জরুরি প্রয়োজনে কেউ ঘরের বাইরে বেরোতে পারছেন না।
সিলেট নগরীর আখালিয়া এলাকার বাসিন্দারা সংবাদমাধ্যমকে বলেন, আমার বাড়িতে কোনোদিনই পানি ঢুকেনি। কিন্তু রাত ১০টার পর থেকে আমার বাড়ির উঠানে পানি প্রবেশ করেছে। চারদিকে এত বন্যার পানি আগে আমি কখনোই দেখিনি। যত সময় যাচ্ছে পানির উচ্চতা ততই বাড়ছে। এ অবস্থায় বাসাবাড়িতে আমার পরিবার নিয়ে খুব আতঙ্কের মধ্যেই রাত পার করছি।
আমার বাড়িতে কোনোদিনই পানি ঢুকেনি। কিন্তু রাত ১০টার পর থেকে আমার বাড়ির উঠানে পানি প্রবেশ করেছে। চারদিকে এত বন্যার পানি আগে আমি কখনোই দেখিনি।
হঠাৎ করে পানি বাড়ায় বিপাকে পড়েছেন বিভিন্ন এলাকার মানুষ। আবার কিছু কিছু এলাকায় স্থানীয়ভাবে উদ্ধার তৎপরতা চালানো হচ্ছে। পানিবন্দি মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে নেওয়া হচ্ছে।
সিলেট নগরীর ১০নং ওয়ার্ডের মোল্লাপাড়া এলাকার বাসিন্দা সেলিম আহমদ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, রাত পৌনে ২টায় সিলেট নগরের মোল্লাপাড়া জামে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয় পানির কারণে যদি কারো বাসাবাড়িতে থাকতে সমস্যা হয়, তাহলে যেন মসজিদে এসে তারা নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ করেন। এ ঘোষণার পর অনেকে মসজিদে আশ্রয় নিয়েছেন। এ অবস্থায় আমি পরিবার আত্মীয়-স্বজন নিয়ে বেশ উৎকণ্ঠার মধ্যে রাত পার করছি।
সিলেট নগরের তালতলা, জামতলা, সোবহানীঘাট, তেরোরতন, উপশহর, কালীঘাটসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় পাশের সুরমা নদীর পানি উপচে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। এসব এলাকার রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় মানুষজন ভোগান্তি নিয়ে পথ চলছেন। অনেক বাসাবাড়ি ও দোকানে পানি উঠেছে। এরই মধ্যে কোথাও কোথাও দেখা দিয়েছে হাঁটুপানি। ঘরের ভেতরে পানি ওঠায় অনেকে নিরাপদে সরে যাচ্ছেন। সিলেটের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার কালীঘাটের বিভিন্ন দোকান তলিয়ে যাওয়ায় সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. আনোয়ার সাদাত জানান, ‘স্থানীয় প্রশাসন বন্যা পরিস্থিতির দিকে সার্বিকভাবে নজর রাখছে। প্রয়োজনীয় স্থানে আশ্রয়কেন্দ্র চালুর জন্য সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) নির্দেশনা দেয়া হয়েছে’।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, ‘গত ১১ জুন থেকে সিলেটে দিনে-রাতে ভারী বর্ষণ হচ্ছে। আর সিলেটের উজানে, ভারতের মেঘালয় ও আসামে বৃষ্টিপাত বেশি হওয়াতে পাহাড়ি ঢলে নদ-নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে’।
সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, সিলেট সদর, দক্ষিণ সুরমা এবং নগর এলাকার নিম্নাঞ্চলে পানি উঠেছে। এখনো বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। ফলে বড় বন্যার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এর আগে, গত ১৫ মে থেকে সিলেটজুড়ে ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছিল। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছিলেন জেলার প্রায় চার লাখ মানুষ।
গোয়াইনঘাটের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাহমিলুর রহমান বলেন, ‘এক মাসের মধ্যে দ্বিতীয় দফা বন্যায় অসংখ্য মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। বন্যা কবলিত এলাকায় ৪২টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে বন্যা কবলিত মানুষদের আশ্রয় কেন্দ্রে আনা হচ্ছে’।
এদিকে, সুনামগঞ্জের সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘন্টায় ১৮৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড।
সুরমা, কুশিয়ারা, যাদুকাটা, বৌলাই নদীসহ অন্য নদনদীর পানি বাড়ছে। সুরমা নদীর ছাতক পয়েন্টে বিপদসীমার ২১৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করায় ভোগান্তিতে পড়েছেন লক্ষাধিক মানুষ।
সুনামগঞ্জ শহরের নবীননগর, ওয়েজখালী, হাছননগর, সুলতানপুরে পানি প্রবেশ করেছে। জেলার তাহিরপুর, দোয়ারা, বিশ্বম্বরপুর, জামালগঞ্জ ও ছাতক উপজেলার সঙ্গে অন্যান্য অংশের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
এদিকে, ছাতক, দোয়ারা ও সদরে বন্যায় তলিয়ে গেছে বহু পাকা রাস্তাঘাট, প্লাবিত হয়েছে হাজারও ঘরবাড়ি, দুই শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শতাধিক মৎস্য খামার। প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের কারণে এখানে সুরমা, চেলা ও পিয়াইন নদীতে পানিবৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
ছাতক, দোয়ারা ও সদর উপজেলায় ২০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, ‘জেলার ৪টি পৌরসভা ও ১২ টি উপজেলায় ২৪৫ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে’।
এদিকে সিলেটসহ দেশের কয়েকটি এলাকায় বন্যার কারণে ১৯ জুন থেকে শুরু হতে যাওয়া এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার আজ শুক্রবার প্রথম আলোকে এই তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, পরীক্ষা শুরুর পরিবর্তিত তারিখ পরে জানানো হবে।
এ বছর এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় মোট পরীক্ষার্থী ২০ লাখ ২১ হাজার ৮৬৮ জন। গত বছর পরীক্ষার্থী ছিল ২২ লাখ ৪৩ হাজার ২৫৪ জন। এ বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় গত বছরের চেয়ে প্রায় সোয়া দুই লাখ পরীক্ষার্থী কমেছে।
এ বছর ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড, মাদ্রাসা এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন সারা দেশের ২৯ হাজার ৫১৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ৩ হাজার ৭৯০টি কেন্দ্রে এসএসসি, দাখিল এবং এসএসসি (ভকেশনাল) পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা।
এবার পরীক্ষার সময় তিন ঘণ্টা থেকে কমিয়ে দুই ঘণ্টা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রশ্নপত্রের এমসিকিউ অংশের জন্য ২০ মিনিট এবং সৃজনশীল অংশের জন্য ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট নির্ধারিত থাকবে।
এর আগে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের কারণে ২৫ জুনের পরীক্ষা এক দিন এগিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তবে এখন বন্যার কারণে সব পরীক্ষাই স্থগিত হয়ে গেল।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৩৩
আপনার মতামত জানানঃ