জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারণে ভবিষ্যতে বিশ্ব তীব্র খাদ্যসংকটের মুখোমুখি হতে পারে বলে অনেক আগে থেকেই সতর্ক করে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। করোনা মহামারির মধ্যে চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। ফলে বিশ্ব এখন এক অভূতপূর্ব খাদ্যসংকটের মুখোমুখি।
এই সংকটের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে চলছে। সামনের মাসগুলোতে বৈশ্বিক খাদ্য পরিস্থিতির আর অবনতি ঘটতে পারে বলে জাতিসংঘ সতর্ক করেছে।এমনকি বিশ্ব দীর্ঘমেয়াদি দুর্ভিক্ষের মুখেও পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ।
২০২২ সালে যেসব খাদ্য আপনার মেন্যুতে রয়েছে, ২০৫০ সাল আসতে আসতে তার মধ্যে ঘটতে পারে বেশকিছু পরিবর্তন। আপনার খাদ্যতালিকায় যোগ হতে পারে নতুন ধরনের গাছগাছড়া, ফল থেকে শুরু করে নকল কলা পর্যন্ত! হ্যাঁ, এমনটাই দাবি করছেন বিজ্ঞানীরা।
এতদিন ধরে বিশ্বের সিংহভাগ মানুষের কাছেই অজানা ছিল, এমন কয়েকটি গাছের তালিকা প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞানীরা। তাদের মতে, ভবিষ্যতে এগুলোই হয়ে উঠতে পারে মানুষের খাদ্য।
কিন্তু হঠাৎ বিজ্ঞানীদের এই অনুসন্ধানের কারণ কী? কারণ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ববাসীকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, বিশ্ববাজারে কেনাবেচা হয় এমন গুটিকয়েক খাদ্যশস্যের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে থাকা কতটা বিপজ্জনক।
এই মুহূর্তে আমাদের ক্যালরির ৯০ শতাংশ আসছে মাত্র ১৫টি খাদ্যশস্য থেকে। তাই মানবজাতির খাদ্যের উৎস নিশ্চিত করতে লন্ডনের রয়্যাল বোটানিক গার্ডেনের বিশেষজ্ঞরা এখন নতুন খাদ্য উপাদান খুঁজছেন।
জলবায়ু পরিবর্তন ‘ফুড শক’ এর ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে, যেখানে উৎপাদিত শস্য মানুষের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে এবং বিশ্বজুড়ে মানুষের প্রধান খাদ্যের দাম দ্রুত বেড়েই চলেছে।
আমাদের খাদ্যের ভবিষ্যৎ কী, তা অনুসন্ধানে কাজ করছেন লন্ডনের রয়্যাল বোটানিক গার্ডেনসের বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশেষ করে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খাদ্যের ক্ষতির ঝুঁকি মারাত্মকভাবে বাড়ছে। ফসলহানির মতো ঘটনা অহরহ ঘটছে। ফলে বিশ্বজুড়ে প্রধান খাদ্যপণ্যের দাম দ্রুত বাড়ছে।
লন্ডনের রয়্যাল বোটানিক গার্ডেনসের গবেষক স্যাম পিরিনন বলেন, ‘আমরা যেসব খাবার খাই, তার বৈচিত্র্যকরণের বিষয়টি ক্ষুধা দূর, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি মোকাবিলা ও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সাহায্য করার অন্যতম উপায়।’
এ প্রসঙ্গে স্যাম পিরিনন আরও বলেন, ‘আমরা জানি, বিশ্বজুড়ে হাজারো ভোজ্য উদ্ভিদ প্রজাতি রয়েছে। বিভিন্ন জনগোষ্ঠী এগুলো খায়। এখানেই আমরা ভবিষ্যতের এই বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের জন্য কোনো সমাধান খুঁজে পেতে পারি।’
বিশ্বব্যাপী ৭ হাজারের বেশি ভোজ্য উদ্ভিদের মধ্যে মাত্র ৪১৭টি ব্যাপকভাবে জন্মায়। এই উদ্ভিদগুলো খাদ্যের জন্য ব্যবহৃত হয়।
এগুলো খায়। এখানেই আমরা ভবিষ্যতের এই বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের জন্য কোনো সমাধান খুঁজে পেতে পারি।’
বিশ্বব্যাপী ৭ হাজারের বেশি ভোজ্য উদ্ভিদের মধ্যে মাত্র ৪১৭টি ব্যাপকভাবে জন্মায়। এই উদ্ভিদগুলো খাদ্যের জন্য ব্যবহৃত হয়।
পান্ডানাস
পান্ডানাস বা পান্ডানাস টেকটেরিয়াস একটি ছোট গাছ। এই গাছ প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে ফিলিপাইন পর্যন্ত উপকূলীয় এলাকায় জন্মে।
পান্ডানাস গাছের পাতা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন এলাকায় খাবারে ব্যবহৃত হয়। এই গাছের ফল দেখতে আনারসের মতো। এই ফল কাঁচা বা রান্না করে খাওয়া যায়।
লন্ডনের রয়্যাল বোটানিক গার্ডেনসের রিসার্চ ফেলো মেরিবেল সোটো গোমেজ বলেন, গাছটি খরা, প্রবল বাতাস ও লবণাক্ততার মতো চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি সহ্য করতে পারে।পান্ডানাস সম্পর্কে মেরিবেল বলেন, এটি একটি জলবায়ু সহনীয় গাছ। এটি খাবার হিসেবে পুষ্টিকর ও সুস্বাদু।
মেরিবেল বলেন, সবচেয়ে বড় কথা হলো, বিশ্বজুড়ে চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতে এই গাছ জন্মাতে পারে।
আমাদের খাদ্যতালিকায় এই গাছ দারুণ বৈচিত্র্য আনতে পারে বলে মনে করেন মেরিবেল। তাঁর মতে, যদি পান্ডানাসকে টেকসইভাবে ব্যবহার করা যায়, তাহলে আমাদের তা আরও ব্যাপকভাবে চাষ করা উচিত।
ভোজ্য বীজ
ভোজ্য বীজ আমাদের অন্যতম ভবিষ্যৎ খাদ্য। এগুলো যেমন সস্তা, তেমনি এতে উচ্চমাত্রায় প্রোটিন রয়েছে, আছে ভিটামিন বি।
মটরশুঁটি, শিমসহ মটরজাতীয় উদ্ভিদ সমুদ্রের তীর থেকে শুরু করে পাহাড়ের ঢাল পর্যন্ত এলাকার বিস্তৃত পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সক্ষম।
বিশ্বে ২০ হাজার প্রজাতির মটরজাতীয় উদ্ভিদ আছে। কিন্তু এগুলোর মাত্র কয়েকটি প্রজাতি আমরা খাদ্যে ব্যবহার করি।
বনবাদাড়ে এখনো শত শত প্রজাতির মটরজাতীয় উদ্ভিদ রয়েছে বলে মনে করা হয়। আর এগুলো এখনো বিজ্ঞানীদের কাছে অজানা রয়ে গেছে।
মোরামা বিন (টাইলোসেমা এস্কুলেন্টাম) বতসোয়ানা, নামিবিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার কিছু অংশে একটি প্রধান খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এসব স্থানে এই বীজ সিদ্ধ করে খাওয়া হয় কিংবা তা পাউডারে পরিণত করা হয়। পরে তা দিয়ে জাউ জাতীয় খাবার বা কোকার মতো পানীয় তৈরি করা হয়।
মটরজাতীয় সব উদ্ভিদই ভোজ্য নয়। কোনগুলো খাওয়ার যোগ্য, কোনগুলো পুষ্টি সরবরাহ করতে পারে, তা অনুসন্ধানে বিশেষজ্ঞরা কাজ করছেন।
সিরিয়াল
সিরিয়াল একধরনের শস্যদানা, যা ঘাস থেকে আসে। এই শস্যদানার ব্যাপক বৈচিত্র্য রয়েছে।
বিশ্বে সিরিয়াল জাতীয় ১০ হাজারের বেশি প্রজাতি রয়েছে। নতুন খাদ্যের উৎস হিসেবে এই প্রজাতিগুলোর ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।
ফোনিও (ডিজিটারিয়া অ্যাক্সিলিস) হলো একটি পুষ্টিকর আফ্রিকান সিরিয়াল। এটি কুসকুস (কারি), পোরিজ (জাউ) ও পানীয় জাতীয় খাবার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। স্থানীয়ভাবে ফসল হিসেবে ফোনিও চাষ করা হয়। এই উদ্ভিদ শুষ্কাবস্থা সহ্য করতে সক্ষম।
নকল কলা
এনসেট বা ‘ফলস বানানা’ কলারই একটি ঘনিষ্ঠ প্রজাতি, কিন্তু শুধুমাত্র ইথিওপিয়ার একটি অংশে এই খাবার খাওয়া হয়।
এনসেট গাছের ফল কলার মতো দেখতে। কিন্তু এই ফল খাওয়া না গেলেও এই গাছের শ্বেতসারবহুল কান্ড এবং মূল গাজন প্রক্রিয়ায় মাধ্যমে খাওয়া যায়। এছাড়াও এটি পরিজ ও রুটি তৈরিতে ব্যবহার করে ইথিওপিয়ানরা।
গবেষণায় দেখা গেছে, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের এই পৃথিবীতে ১০০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষকে খাওয়ানোর সক্ষমতা রয়েছে কলার মতো দেখতে এই শস্যটির।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৩০
আপনার মতামত জানানঃ