রাজধানীর লালবাগ শহীদ নগর এলাকার একটি বাসা থেকে মোছা. শিফা আক্তার (২৬) নামের সৌদিফেরত এক তরুণীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
বুধবার সকাল ৬টার দিকে শহীদ নগর এলাকার ওই বাসা থেকে উদ্ধার করে মরদেহটি ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।
দুই সপ্তাহ আগে শিফা দেশে ফিরেছেন। এরপর থেকে ভাইয়ের বাসাতেই ছিলেন।
লালবাগ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. কামরুল আলম বলেন, খবর পেয়ে লালবাগের শহীদ নগর ৪ নং গলির এলাকার একটি বাসার নিচতলা থেকে সিলিংফ্যানের সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করি। পরে আইনি প্রক্রিয়া শেষে মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়।
তিনি আরও বলেন, শিফা আক্তার দুই সপ্তাহ আগে সৌদি আরব থেকে ঢাকায় ভাইয়ের বাসায় আসেন। মঙ্গলবার (২৬ এপ্রিল) রাতে হাসান নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে তার মোবাইলে কথা হয়। কথা বলার পরেই সে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে বলে জানতে পেরেছি। মোবাইল ফোনটি আমাদের কাছে রয়েছে। মোবাইল ফোনের কলরেকর্ড যাচাই করে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে। এরপরও আমরা বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছি। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পেলে মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যাবে বলেও জানান তিনি।
নিহতের ভাই শামীম বলেন, আমার বোন বেশ কিছুদিন সৌদি আরব ছিলেন। দুই সপ্তাহ আগে বিমানবন্দর থেকে তাকে আমার বাসায় নিয়ে আসি। জানতে পেরেছি হাসান নামের এক ছেলের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল। গত রাতে ফোনে তাদের কথা হয়। আমি একটি কারখানায় কাজ করি। রাত সাড়ে ১১টার দিকে বাসা থেকে বেরিয়ে যাই।
তিনি বলেন, বাসায় আমার স্ত্রী ও দুই বাচ্চা ছিল। আমি সেহরির সময় বাসায় ফিরি। এসে আমার বোনের ঘরের দরজা বন্ধ পাই। অনেক ডাকাডাকি করলেও দরজা খোলে না। পরে দরজা ভেঙে ফ্যানের সঙ্গে তাকে ঝুলন্ত অবস্থায় পাই। এরপর পুলিশে খবর দেওা হলে তারা মরদেহ উদ্ধার করে।
তিনি আরও বলেন, আমাদের গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট থানার দুধ পাতিল (মোল্লাবাড়ি) গ্রামে। আমার বাবা মৃত আবদুর রউফ। আমি পরিবার নিয়ে লালবাগের শহীদ নগর ৪ নং গলির ণারায়ন ধর রোডের ৬/৩/এ নম্বর বাসায় ভাড়া থাকি।
অভাবের তাড়নায় পরিবারকে সুখে রাখতে স্বদেশ ও স্বজনদের ছেড়ে ভিনদেশে পাড়ি দেয়া প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে রয়েছে অনেক নারী শ্রমিকও। যার একটি বড় অংশ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে গৃহকর্মীর কাজে নিয়োজিত। প্রবাসে থাকা নারী গৃহকর্মী নির্যাতনের কথা আমরা প্রায় শুনে আসছি মিডিয়ার মাধ্যমে। কিছু কিছু ঘটনার বিবরণ হতবাক করে দেয় সবাইকে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবে এক সময় বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও নারী গৃহকর্মী পাঠানোর মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় দেশটির সরকার।
দুই সপ্তাহ আগে শিফা দেশে ফিরেছেন। এরপর থেকে ভাইয়ের বাসাতেই ছিলেন।
অন্যদিকে বিদেশে নারী গৃহকর্মী দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে বেশকিছু বিধিমালা থাকলেও কিছু অসাধু ট্রাভেল এজেন্সি সরকারের দেয়া নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ভাড়াটে দালালদের মাধ্যমে নানা রকম মিথ্যে প্রলোভন দেখিয়ে হাজার হাজার নারীকে বিদেশে পাঠায়। এর মধ্যে সব থেকে বেশি নারী শ্রমিক পাঠানো হয়েছে সৌদি আরবে।
আর এই সৌদি আরবেই গৃহকর্মী নির্যাতনের খবর শোনা যায় অনেক বেশি। এমনকি নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে অনেক গৃহকর্মীকে পালিয়ে এসে রাস্তায় ঘুরতেও দেখা গেছে। মাঝে মধ্যে এমন কিছু ভয়ঙ্কর নির্যাতনের খবর আসে যা কল্পনাতীত।
অভাব-অনটন বেশি থাকা এবং আয়-উপার্জনের সুযোগ কম থাকায় প্রতিবছর বহু বাংলাদেশি বিদেশে পাড়ি জমান। সাম্প্রতিক সময়ে পুরুষের পাশাপাশি বিদেশগামী নারী কর্মীর সংখ্যাও দ্রুত বাড়ছে। তারা যান মূলত মধ্যপ্রাচ্যে এবং গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে। কিন্তু সেখানে নারী কর্মীরা শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
প্রবাসে কাজের জন্য যাওয়া নারী কর্মীদের ওপর করোনা মহামারির প্রভাব যাচাইয়ে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু) পরিচালিত এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে যে, পরিবারের ভাগ্য বদলাতে বিদেশে কাজ করতে গিয়ে কর্মস্থলে শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়েছেন ৩৫ শতাংশ নারী কর্মী। মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার ৫২ শতাংশ আর যৌন নিপীড়নের শিকার ১১ শতাংশ নারী। নিয়োগকর্তা ও তার স্ত্রীর হাতে এসব নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। দেশে ফিরে তালাক, অসুস্থতা, সামাজিক কলঙ্কসহ নানা সমস্যার মধ্যে পড়েছেন ২২ ভাগ নারী।
যেসব নারী গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করার জন্য বিদেশে যান, তাদের বেশির ভাগের বয়স ২৫ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে। অসচ্ছল বা স্বামী পরিত্যক্ত নারীরাই মূলত কাজ করার জন্য এসব দেশে যাচ্ছেন। যখন নারী শ্রমিকদের কথা আসে তখন তাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও সামনে আসে।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, এসব প্রবাসী নারীকর্মীর নিরাপত্তার বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। নারীকর্মীদের বেশিরভাগই শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার। গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলেও তাদের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে দাসীর মতো ব্যবহার করা হচ্ছে।
এমন অনেক ঘটনার বিবরণ আমরা খবরের কাগজে দেখতে পেয়েছি। যে স্বপ্ন নিয়ে আত্মীয়স্বজন ছেড়ে প্রবাসে পাড়ি জমাচ্ছেন নারীরা, তা খুব কম সময়ের ব্যবধানেই বালির বাঁধের মতো ভেঙে যাচ্ছে। এ নারীদের অনেকেই কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গৃহকর্মী নিয়োগের কথা বলে তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে যৌনকর্মী হিসেবে। তারা সেখানে গিয়ে কী কাজ করছেন, কেমন আছেন, তার দেখভালও সরকার করে না। বিদেশে নারী কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে দালালদের প্রতারণা বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোকে সক্রিয় হতে হবে।
অন্যদিকে, দেশে ফেরা এসব অভিবাসী নারী শ্রমিকের অনেককেই পড়তে হয় নতুন মানসিক চাপে। সমাজ এমনকি পরিবারের সদস্যদের কাছেও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির শিকার হতে হয় তাদের। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বামীরা তাদের তালাক পর্যন্ত দেন আর অবিবাহিত নারীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সৃষ্টি হয় শঙ্কা ও জটিলতা। ফলে সার্বিকভাবে এই বিষয়গুলো কতটা ভয়ানক তা সংশ্লিষ্টদের আমলে নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিশ্চিত জরুরি বলেই প্রতীয়মান হয়।
তারা বলেন, বলার অপেক্ষা রাখে না, এর আগেও এমন বিষয় উঠে এসেছে যে, চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে কিংবা নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরে আসা নারীকর্মীর সংখ্যা কমছে। আমরা বলতে চাই, স্বচ্ছলতার আশায় বিদেশ গমন করে নির্যাতিত হয়ে ফিরে এলে তা কতটা ভয়ানক সেটা অনুধাবন করা অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের কর্তব্য হওয়া দরকার, বিদেশে কর্মরত নারী শ্রমিকের সুরক্ষা সংক্রান্ত সামগ্রিক বিষয় নিয়ে উদ্যোগী হওয়া।
আরও বলেন, সর্বোপরি, আমরা বলতে চাই, বাংলাদেশ জনসংখ্যাবহুল দেশ, ফলে জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করার বিষয়টি জরুরি। এ ক্ষেত্রে, নারীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। একইসঙ্গে বিদেশে কর্মরত নারী শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬১১
আপনার মতামত জানানঃ