মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত সংঘর্ষে ৫০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন। তাদের অধিকাংশই শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক। কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর। ব্যবসায়ীরা টার্গেট করে সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালান বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই হামলায় দুই পক্ষই লাঠিসোটা ও দেশীয় অস্ত্র ব্যবহার করে।
মঙ্গলবার দুপুর একটার পর পুলিশ গিয়ে ব্যাপক রাবার বুলেট ও টিয়ার গ্যাস ছুড়ে সংঘর্ষ থামানোর চেষ্টা করে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ পুলিশ টিয়ার গ্যাস ও রাবার বুলেট ছোড়ে ঢাকা কলেজের দিকে। ব্যবসায়ীরা তাদের পিছনেই ছিলেন।
আর ব্যবসায়ীদের অভিযোগ ছাত্ররা কলেজের ১০ তলা ভবনের ছাদে অবস্থান নিয়ে তাদের ওপর হামলা চালায়। তবে দুই পক্ষেরই অভিযোগ পুলিশ শুরুতে নিষ্ক্রিয় ছিলো।
বিকেল ৪টার দিকে সংঘর্ষ থামাতে ঢাকা কলেজের ছাত্রাবাসগুলো বন্ধের ঘোষণা দেয়ার পর ফের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এদিকে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সাথে একাত্মতা জানিয়ে ইডেন কলেজ, সিদ্ধেশ্বরী মহিলা কলেজ ও তিতুমীর কলেছের শিক্ষার্থীরাও তাদের কলেজের সামনে অবস্থান নেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা একাত্মতা ঘোষণা করেছেন।
যে সামান্য ঘটনা থেকে সংঘর্ষ
শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সোমবার রাত ১০টার দিকে নিউমার্কেটের চার নাম্বার গেটে ঢাকা কলেজের কয়েকজন ছাত্র একটি দোকান থেকে বার্গার কিনতে গেলে দাম নিয়ে ঝামেলা হয়। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে হাতাহাতি হয়। তখন দোকানের কর্মচারীরা এক হয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হয়।
কলেজে ফিরে গিয়ে শিক্ষার্থীরা বন্ধুদের নিয়ে ফিরে আসলে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যায়। আরো শিক্ষার্থী আসলে সংঘর্ষ বাধে। রাত তিনটার দিকে ওই সংঘর্ষ শেষ হয়। পুলিশ এসে লাঠিচার্জ ও টিয়ারগ্যাস ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে। তখন ঢাকা কলেজের সামনে পুরো মিরপুর রোড বন্ধ হয়ে যায়।
নিউ মার্কেট দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ শহিদ বলেন, কোনা চাঁদাবাজির ঘটনা নয়, বার্গারের দাম নিয়ে ঝামেলা হয়েছে। তবে পুলিশ চাইলে রাতেই দুইপক্ষের সঙ্গে বসে বিষয়টি সমাধান করে দিতে পারত।
তিনি অভিযোগ করেন, সকাল ৯টার দিকে ছাত্ররা আবার বেরিয়ে এলেও পুলিশ আসে দুপুর একটার পরে। তারা ঠিক সময়ে আসলে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ত না।
ঢাকা কলেজের ছাত্র ও ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক ফুয়াদ হাসান অভিযোগ করেন, মঙ্গলবার রাতে নিউমার্কেটে ছাত্রদের মারধর করার পরও পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এরপর ছাত্ররা উত্তেজিত হলে সংঘর্ষ হয়। তখন পুলিশ এসে ব্যবসায়ীদের পক্ষ নিয়ে ছাত্রদের ওপর চড়াও হলে পরিস্থিতি খারাপ হয়। রাতেই এটা সমাধান করা যেত।
আমাদের বলা হয়েছিল পুরো বিষয়টি সমাধান না হওয়া পর্যন্ত নিউমার্কেটের দোকাপাট খুলবে না। কিন্তু সকালে আবার দোকানপাট খুললে ছাত্ররা প্রতিবাদ জানাতে বের হয়ে আসে। সকাল ৯টার দিকে ফের সংঘর্ষ শুরু হলেও পুলিশ আসেনি।
পুলিশ আসে দুপুর একটার পর। আর এসে ছাত্রদের লক্ষ্য করে রাবার বুলেট ও টিয়ারগ্যাস ছোড়ে। ব্যবসায়ীরা পুলিশের ছত্রছায়ায় থেকে আমাদের ওপর হামলা করে।
নিহত হয়েছে পথচারী
নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনায় একজন নিহত হয়েছেন। তার নাম নাহিদ হাসান (১৮)। তিনি একজন কুরিয়ার সার্ভিস কর্মী। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা কলেজের সামনে সংঘর্ষ চলাকালে তিনি আহত হন।
গত রাত ৯টা ৪০ মিনিটে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
ঢামেক হাসপাতাল পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ বাচ্চু মিয়া জানান, নাহিদ হাসানের মাথায় ও পায়ে আঘাতের গুরুতর চিহ্ন রয়েছে। তার বাসা রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে। তিনি এলিফ্যান্ট রোডের একটি কুরিয়ার সার্ভিসে চাকরি করতেন। অফিসে যাওয়ার পথে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে তিনি আহত হন।
ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. তৌফিক এলাহী জানান, সংঘর্ষের ঘটনায় এক শিক্ষার্থীসহ চারজন ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। এর মধ্যে নাহিদ মারা গেছেন। মোরসালিন নামে একজন দোকান কর্মচারীর অবস্থাও আশঙ্কাজনক। বাকি দুইজন ভালো আছেন। তারা হলেন ইয়াসিন (২০) এবং ঢাকা কলেজের দর্শন বিভাগের ৩য় বর্ষের ছাত্র কানন চৌধুরী (২৩)।
নিহত নাহিদের বাবা নাদিম হাসান জানান, নাহিদ সকালে কামরাঙ্গীরচর দেওয়ান বাড়ি এলাকার বাসা থেকে বাটা সিগনাল তার কুরিয়ার সার্ভিস অফিসের যাওয়ার জন্য বের হন। পরে নাহিদ হাসপাতালে ভর্তি বলে ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে জানতে পারেন।
শুভ নামে একজন দুপুরের দিকে আহত অবস্থায় নাহিদকে হাসপাতালে আনেন। তিনি জানান, নিউমার্কেট এলাকায় সংঘর্ষের সময় আহত অবস্থায় নাহিদ রাস্তায় পড়েছিলেন।
আইসিইউতে মুমূর্ষ অবস্থায় চিকিৎসাধীন মোরসালিলেন বাড়ি কুমিল্লার দাউদকান্দি এলাকায়। বর্তমানে তিনি কামরাঙ্গীরচর পশ্চিম রসুলপুর এলাকায় থাকেন। তার ভাই নূর মোহাম্মদ জানান, নিউমার্কেট এলাকার নিউ সুপার মার্কেটের একটি দোকানে মোরসালিন কাজ করেন।
শুরুতে নিষ্ক্রিয় পরে বাড়াবাড়ি পুলিশের
দুই পক্ষই শুরুতে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা ও পরে বাড়াবাড়ির অভিযোগ করেছেন। আলী হোসেন নামে একজন ব্যবসায়ী বলেন, ভাই আমাদের এখন ঈদের বাজার। গত দুই বছর ধরে আমরা ব্যবসা করতে পারিনি। এখন দোকানপাট বন্ধ থাকলে আমরা পথে বসে যাব।
তাই সোমবার রাতেই আমরা এর একটা সমাধান চেয়েছিলাম। কিন্তু পুলিশ কোনো উদ্যোগ নেয়নি। আর সকালেও পুলিশ মোতায়েন রাখা হয়নি।
তিনি জানান, ওই এলাকায় শুধু নিউ মার্কেট নয় আরো অনেক মার্কেট আছে। ছোট বড় মিলিয়ে অনেক ব্যবসায়ী এখানে ব্যবসা করেন।
একজন ছাত্র আব্দুল কাইউম বলেন, আমাদের সহপাঠীরা এখন হাসপাতালে আছে। দুইজন আছে আইসিইউতে। আমরা এটা চাইনি। আমরা আমাদের ওপর হামলার বিচার চেয়েছিলাম। কিন্তু পুলিশ আমাদের ওপর উল্টো হামলা করেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, সোমবার রাতে পুলিশের আচরণ ছিলো ভয়াবহ। একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বলতে দেখা যায়, তোদের রাজনীতি খেয়ে দেব।
তবে রমনা জোনের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার সাজ্জাদ হোসেন পুলিশের বাড়াবাড়ি প্রসঙ্গে বলেন, মঙ্গলবার সকালে পুলিশ আশপাশেই ছিলো। তারা পরিস্থিতি পর্যক্ষেণ করছিলেন। ফলে অ্যাকশনে যেতে সময় লেগেছে। ইচ্ছে করে সময়ক্ষেপণ করা হয়নি।
আর পুলিশ কমিশনার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, পুলিশকে পরিস্থিতি বুঝে ব্যবস্থা নিতে হয়। পুলিশ তাই করেছে।
যদিও গতকাল সকালে নিউ মার্কেট থানায় গিয়ে দেখা গেছে রিজার্ভ ফোর্সের পুলিশ সদস্যরা বসে আছেন। তারা জানান উপরের আদেশ না আসা পর্যন্ত তারা বের হবেন না।
এদিকে সন্ধ্যার পর নিউমার্কেট ও আশপাশের এলাকায় মেবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫১৫
আপনার মতামত জানানঃ