কক্সবাজারের উখিয়া ৫ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ফের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। আগুনে তিন শতাধিক রোহিঙ্গা বসতি পুড়ে ছাই হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরও শতাধিক বসতি। আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে যাচ্ছে। মঙ্গলবার বিকালে উখিয়ার লম্বাশিয়া ৫ নম্বর ক্যাম্পে এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটনা। আগুনের তীব্রতা বেশি বলে জানিয়েছেন রোহিঙ্গারা।
ক্যাম্পের বাসিন্দা মো. সাইফুল জানান, তাদের ক্যাম্পে একটি ঝুপড়ি ঘরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। বাতাস থাকায় দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। আমরা সবাই মিলে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছি। তবে আগুনের অনেক তীব্রতা বেশি।
মঙ্গলবার (৮ মার্চ) বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে উখিয়ার লম্বাশিয়া ৫ নম্বর ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। পরে দুই ঘণ্টার চেষ্টায় সাড়ে ৫টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।
অগ্নিকাণ্ডে এক শিশুর মৃত্যু হলেও দিনেরবেলা অগ্নিকাণ্ড হওয়ায় তেমন হতাহত হয়নি বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত ত্রাণ ও শরণার্থী প্রত্যাবাসন কমিশনার ডা. শামসুদ্দৌজা নয়ন।
তিনি বলেন, ‘ক্যাম্পের একটি ঘর থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বলে জেনেছি। বাতাস থাকায় দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এক শিশু মারা গেছে বলে জানা গেলেও তার পরিচয় এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও এখনো জানা যায়নি।’
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উখিয়া স্টেশনের কর্মকর্তা মো. এমদাদুল হক বলেন, ‘উখিয়ার ৫ নম্বর ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডের খবর পেয়ে আমাদের টিম ঘটনাস্থলে রওনা দেয়। অন্য এলাকার টিম এসে কাজে যোগ দেয়। প্রায় দুই ঘন্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।’
১৪ এপিবিএনের (আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন) অধিনায়ক (পুলিশ সুপার) নাইমুল হক জানান, আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে চেষ্টা চলছে।
সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। গত ৯ জানুয়ারি কক্সবাজারের উখিয়ার শফিউল্লাহ কাটা নামে একটি শরণার্থী শিবিরে অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ৬০০ ঘর পুড়ে যাওয়ায় তিন হাজারের বেশি মানুষ আশ্রয় হারিয়েছেন। এর আগে ২ জানুয়ারি উখিয়া বালুখালী ২০ নম্বর ক্যাম্পের জাতিসংঘের অভিবাসন বিষয়ক সংস্থা (আইওএম) পরিচালিত করোনা হাসপাতালের জেনারেটর থেকে এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
এছাড়া গত বছরের ২২ মার্চ উখিয়ার বালুখালীতে আগুনে পুড়ে মারা যায় ১৫ জন রোহিঙ্গা। তখন ১০ হাজারের মতো ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
এদিকে বারবার এভাবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন কক্সবাজারের সচেতন মহল। গত এক বছরে এভাবে কয়েকবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। তাদের মতে এটি রহস্যজনক। সচেতন মহলের মত এর পেছনে কোন মহলের ষড়যন্ত্র বা নাশকতা আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা দরকার।
শরণার্থী শিবিরগুলোতে বারবার অগ্নিকাণ্ড ঘটলেও তা প্রতিরোধে শক্ত কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে শিবিরে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা বাড়ছে। প্রতিবছর শিবিরে ৫০-৬০টি মতো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে অগ্নিকাণ্ড বেড়েই চলেছে। এতে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে। বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি।
রোহিঙ্গা নেতাদের অভিযোগ, শরণার্থী শিবিরগুলোতে বারবার অগ্নিকাণ্ড ঘটলেও তা প্রতিরোধে শক্ত কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে শিবিরে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা বাড়ছে। প্রতিবছর শিবিরে ৫০-৬০টি মতো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা বলছেন, আগুন লাগার প্রকৃত কারণ চিহ্নিত করার মতো ‘প্রযুক্তি’ তাদের হাতে নেই। তবে আগের চেয়ে অগ্নিকাণ্ড কমেছে।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে ৬৫টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। ২০২০ সালে ঘটেছিল ৮২টি। যদিও রোহিঙ্গাদের হিসাবে এই সংখ্যা আরও বেশি। এছাড়া চলতি বছর ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত ছোট-বড় চারটি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এরমধ্যে সোমবার (১৭ জানুয়ারি) উখিয়ার ইরানি পাহাড়ের ৫ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন লেগে ২৯টি ঘর পুড়ে গেছে।
এর আগে ৯ জানুয়ারি উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের শফিউল্লাহ কাটা রোহিঙ্গা শিবিরের প্রায় ৬০০ ঘর পুড়ে যায়। কিন্তু টেকনাফের চেয়ে বেশি অগ্নিকাণ্ড ঘটে উখিয়ার শরণার্থী শিবিরে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উখিয়া স্টেশনের কর্মকর্তা মো. এমদাদুল হক জানান, আগুন লাগার প্রকৃত কারণ চিহ্নিত করা খুবই কঠিন। দেশে সেই প্রযুক্তিও নেই। অগ্নিকাণ্ডের পর ক্ষয়ক্ষতি ও ঘটনাস্থল বিশ্লেষণ করে ঘটনার কারণ অনুমান করা হয়ে থাকে।
তিনি আরও জানান, মূলত রোহিঙ্গাদের অসাবধানতার কারণে ক্যাম্পে শীত মৌসুমে এ ধরনের ঘটনা ঘটে। সবাইকে আরও বেশি সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। তবে আগের তুলনায় শিবিরে আগুন লাগার ঘটনা কমেছে।
সাধারণ রোহিঙ্গারা বলছে, শিবিরে বারবার আগুন লাগার পেছনে অন্য কোনও কারণ আছে। তবে এটা সত্য, কিছু ঘটনা রোহিঙ্গাদের অসাবধানতার কারণে ঘটছে। কর্তৃপক্ষের উচিত ক্যাম্পে আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে তাৎক্ষণিক নেভানোর ব্যবস্থা রাখা। এ ছাড়া আগুন লাগার ঘটনায় তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন করা দরকার। তাছাড়া আগুনের ঘটনা থামবে না।
রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংগঠনের কর্মী জানান, আশ্রয়কেন্দ্রে কিছু খারাপ লোক রয়েছে, যারা আগুন লাগার ঘটনায় জড়িত। তারা চায় এখানে সবসময় অশান্তি থাকুক। তাছাড়া কিছু ঘটনা রোহিঙ্গাদের অবহেলার কারণেও ঘটে থাকে। ফলে শিবিরে আগুন লাগার ঘটনা ঠেকাতে কর্তৃপক্ষের পরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) জানায়, শিবিরে আগুন লাগার ঘটনা উদ্বেগনজনক হারে বাড়ছে। ২০২১ সালের প্রথম চার মাসে ৮৪ বার আগুন লাগে, যা আগের বছরের মোট সংখ্যার চেয়ে বেশি। এতে অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন, গৃহহীন হয়েছেন কয়েক হাজার রোহিঙ্গা।
এইচআরডব্লিউ বলছে, এসব ঘটনায় রোহিঙ্গাদের অবহেলার কথা যেমন শোনা যাচ্ছে, তেমনি কেউ কেউ নাশকতার কথাও বলছেন। তবে, বাস্তবে কী ঘটছে সেটা জানা যাচ্ছে না। কারণ, আগুন লাগার ঘটনাগুলো যথাযথ তদন্ত হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলেন, শিবিরে বারবার আগুন লাগার কারণে মানুষের মাঝে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তাছাড়া শিবিরে অগ্নিনির্বাপণ ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রসহ পানির ব্যবস্থা না থাকায় বারবার আগুনে পুড়ে ছাই হচ্ছে শত শত ঘর।
তারা বলেন, শিবিরে আগুন লাগার কারণ বের করা না গেলে এ ধরনের ঘটনা রোধ করা অসম্ভব। সবার সমন্বিত তদন্তে কোনটি অগ্নিকাণ্ড আর কোনটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ঘটনা, তা বের করা দরকার। অন্যথায় এ ধরনের ঘটনা ঠেকানো যাবে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০১২
আপনার মতামত জানানঃ