দেশে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নারী ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে নিগ্রহের ঘটনাও। ধর্ষণসহ বেশির ভাগ যৌন নিপীড়নের ঘটনা বেশি পার্বত্য চট্টগ্রামে। করোনাকালে গত দুই বছরে নিপীড়নের সংখ্যা এর আগের বছরের চেয়ে বেশি। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান কাপেং ফাউন্ডেশনের গবেষণায় এ তথ্য পাওয়া গেছে।
কাপেং ফাউন্ডেশন ২০০৭ সাল থেকে দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয় নিয়ে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা নথিবদ্ধ করে। এর পাশাপাশি নিজেরাই এসব ঘটনার তথ্যানুসন্ধান করে গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করে।
কাপেং ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত বছর (২০২১) সমতল ও পাহাড়ে মোট ২২টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে চারজন নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। ধর্ষণের চেষ্টা ছিল ১২টি। অপহরণ, পাচার ও নিগ্রহের ঘটনা ছিল একটি করে। শারীরিক হেনস্তার শিকার হন দুজন। সব মিলিয়ে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৪২টি।
২০২০ সালে মোট নিপীড়নের সংখ্যা ছিল ৬২টি। এর মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ২০টি। আর দুই নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। শারীরিক হেনস্তার শিকার হন ১৬ জন। আর অপহরণের শিকার হন ছয়জন। এ বছর ঘটা নিপীড়নের ঘটনা তার আগের বছরের বা ২০১৯ সালের দ্বিগুণ। ২০১৯ সালে মোট নিপীড়নের ঘটনা ছিল ৩৩টি। ধর্ষণের ঘটনা ছিল ১০টি। আর ধর্ষণের চেষ্টা, অপহরণসহ অন্য নিপীড়নের সংখ্যা ছিল ২৩টি।
কাপেংয়ের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত বছর ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নারীদের ওপর সহিংসতার যে ৪২টি ঘটনা ঘটেছে, এর মধ্যে ২৪টিই ঘটেছে পার্বত্য চট্টগ্রামে। ২২টি ধর্ষণের ঘটনার মধ্যে ১২টিই পাহাড়ে হয়েছে। এসব ঘটনায় ভুক্তভোগী নারীদের সংখ্যা ৪৬ জন। আর এর মধ্যে ২৪ জনই পাহাড়ের।
২০১৬ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত কাপেং ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক (বিআইডব্লিউএন) ও আদিবাসীবিষয়ক আন্তর্জাতিক ওয়ার্ক গ্রুপের (আইডব্লিউজিআইএ) আরেক গবেষণা প্রতিবেদনে ‘বাংলাদেশে আদিবাসী নারী ও মেয়েদের অবস্থা: এক নজরে সমস্যা ও উদ্বেগের বিষয়’-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে অন্তত ৪৬৬ জন ‘আদিবাসী’ নারী ও মেয়েদের ওপর সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক আন্তর্জাতিক কমিশনের (সিএইচটি) একটি গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২১৫টি মামলার মধ্যে একটিতেও কোনো ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি।
২০১৭ সালে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর কাপেং ফাউন্ডেশনের মানবাধিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই বছরে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ওপর সহিংসতার ঘটনায় মোট ৪৮টি মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ২০টি সমভূমি ভূমি থেকে ২৮টি পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক আন্তর্জাতিক কমিশন থেকে করা হয়েছে।
এসব মামলায় ৭৫ জন আসামির মধ্যে ৬৫ জন বাঙালি সম্প্রদায়ের এবং চারজন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর।
কাপেং ফাউন্ডেশনের সমন্বয়ক (প্রকল্প) ফাল্পুনী ত্রিপুরা সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর যেসব নারী সহিংসতার শিকার হচ্ছেন, তাদের প্রায় সবাই আর্থিক ও সামাজিকভাবে প্রান্তিক। তাদের সংগতি একেবারেই কম। অন্যদিকে তাদের নিপীড়নকারীরা অনেক প্রভাবশালী।
যখন হুমকি-ধমকিতে কাজ হয় না, তখন তারা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে ভয় তৈরি করার জন্য ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির আশ্রয় নেয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারীদের ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে বলে অভিযোগ পাহাড়িদের সংগঠনগুলোর। বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, পাহাড়ে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীকে পূর্বপুরুষের বসতভিটা থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদের জন্য নারীদের ওপর যৌন নির্যাতনকে একটি মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
তারা জানান, অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষ পাহাড়ি এলাকায় বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের পূর্বপুরুষদের জমি থেকে উচ্ছেদ করছে, যা তাদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করছে। প্রভাবশালী ব্যক্তি ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে ক্রমাগত হুমকি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা আরও বাড়াচ্ছে।
যখন হুমকি-ধমকিতে কাজ হয় না, তখন তারা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে ভয় তৈরি করার জন্য ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির আশ্রয় নেয়।
তারা মনে করেন, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ওপর এ ধরনের সহিংসতা তাদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করে অন্যত্র স্থানান্তর করতে বাধ্য করার একটি হাতিয়ার।
আরও বলেন, ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা চারটি উপায়ে তৈরি হয়, তাদের বাড়িঘর আক্রমণ, তাদের আয় উৎসে আক্রমণ, তাদের উপাসনা স্থানে আক্রমণ এবং নারীদেরকে যৌন হয়রানি করা। যৌন সহিংসতা ও হয়রানি পাহাড়ি সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে ভয় সৃষ্টি করে এবং একপর্যায়ে তারা নিরাপত্তা ও মর্যাদার রক্ষার জন্য অন্যত্র চলে যেতে বাধ্য হয়।’
তারা বলেন, ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারীদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা এবং হার ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিতে দীর্ঘদিন ধরেই উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুযায়ী, এখনো স্থানীয় সরকারে, প্রশাসনে, ক্ষমতা হস্তান্তর হয়নি। তাই সেখানে পাহাড়ি নারীদের ওপর নির্যাতনের প্রতিরোধ বা প্রতিকারে রাষ্ট্র বা প্রশাসনের সহযোগিতা পাওয়া দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিশু থেকে শুরু করে নারী নির্যাতনের যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেগুলোর প্রথমত অস্বীকৃতি, মামলা না নেওয়ার প্রবণতা, তদন্ত সৎ ও সুষ্ঠু না হওয়ার মতো অসংখ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন হওয়ার তথ্য আমাদের নজরে এসেছে।’
মানবাধিকার কর্মীরা বিশ্বাস করে, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর নিরাপত্তা ও মানবাধিকার নিশ্চিত করার জন্য একটি নিরপেক্ষ দেশ গড়তে হবে যেখানে শ্রেণি, জাতি, ভাষা, সামাজিক অবস্থা ও ধর্ম নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৫৭
আপনার মতামত জানানঃ