ঐতিহ্যগতভাবে রক্ষণশীল ইসলামী দেশ হিসেবেই পরিচিত সৌদি আরব ক্রমেই হাজার বছরের পুরোনো খোলস ছেড়ে ক্রমেই বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। কঠোর ইসলামপন্থী দেশটি ধীরে ধীরে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে শুরু করেছে। আর সেই যাত্রায় একেবারে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন দেশটির যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান।
দেশটি তার সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে এবার জাতীয় পতাকা, জাতীয় প্রতীক এবং জাতীয় সংগীতে সংশোধন আসছে সৌদি আরবে। নতুন পতাকাতে আর দেখা যাবে না পবিত্র কালেমা তাইয়েবা। আরবী ও ইংরেজি ভাষায় লেখা থাকবে সৌদি আরবের নাম।
গত সোমবার দেশটির শূরা কাউন্সিল পতাকা পরিবর্তনের পক্ষে সায় দিয়েছে। প্রায় ৫০ বছরের পুরোনো রাজকীয় ডিক্রির একটি খসড়া সংশোধনের পক্ষে ভোট দিয়েছে শূরার সব সদস্য।
সোমবার মজলিশে শূরার সদস্য সাআদ আল-উতাইবির প্রস্তাবের পর এতে অন্য সদস্যরা সম্মতি দেন।
শূরার নিরাপত্তা ও সামরিক বিষয়ক কমিটির সম্মতির পর জাতীয় পতাকা, প্রতীক ও সংগীত সংস্কারের এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন এখন সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজের চূড়ান্ত অনুমোদনের ওপর নির্ভর করছে।
সৌদির শূরা কাউন্সিলের সম্মতিই যে কোনো আইন বাস্তবায়ন ও সংস্কারে চূড়ান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়। সে হিসেবে বাদশাহ’র অনুমোদন এখন আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের ‘ভিশন ২০৩০’ এর অংশ হিসেবে পতাকা ও জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করা হচ্ছে।
সৌদি ভিশন ২০৩০ এর লক্ষ্য ও উদ্যোগকে সমর্থন করে এমন সাম্প্রতিক বছরগুলোর রিভিউ এবং বহু ক্ষেত্রে পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে নতুন করে সেই পতাকাকে সংশোধন করার কথা বলা হয়েছে। সবক তার রিপোর্টে বলেছে, বেসিক ল’ অব গভর্নেন্সের ৪ অনুচ্ছেদে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন মেটানোর অনুষঙ্গ হিসেবে জাতীয় সংগীতকে সংজ্ঞায়িত করে এবং সিস্টেমের বিধানগুলোর বিশদ বর্ণনা করে— এমন একটি ব্যবস্থার অভাব পূরণ করা প্রয়োজন। এতে আরও বলা হয়, জাতীয় প্রতীক ব্যবহারের জন্য নির্ধারক এবং নিয়ন্ত্রণ স্থাপন প্রয়োজন। তা লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা জরিমানার বিধান নির্ধারণ করতে হবে।।
দেশটি তার সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে এবার জাতীয় পতাকা, জাতীয় প্রতীক এবং জাতীয় সংগীতে সংশোধন আসছে সৌদি আরবে। নতুন পতাকাতে আর দেখা যাবে না পবিত্র কালেমা তাইয়েবা। আরবী ও ইংরেজি ভাষায় লেখা থাকবে সৌদি আরবের নাম।
সৌদি আরবের স্থানীয় একটি দৈনিকের খবরে হয়, সংস্কারে জাতীয় পতাকা ও সংগীতে কি পরিবর্তন হবে তা জানানো হয়নি, তবে এগুলোর আইনে সংশোধন আনা হবে। আইনে কী ধরনের সংশোধন আসতে পারে সে ব্যাপারে স্পষ্ট কিছু জানায়নি পত্রিকাটি।
তবে পতাকার প্রয়োজনীয় সম্মান এবং কালেমাখচিত পতাকাকে অবহেলা ও অনিচ্ছাকৃতভাবে পড়ে যাওয়া থেকে সুরক্ষার জন্যই এই আইন হতে পারে বলে দেশটির সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে।
গত সপ্তাহে পতাকা অবমাননার অভিযোগ চার বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তারও করেছে সৌদি পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে সৌদি পতাকাকে ময়লার ভাগাড়ে ফেলে অবমাননার অভিযোগ আনা হয়েছে।
ঐতিহ্যগতভাবে রক্ষণশীল ইসলামী দেশ হিসেবেই পরিচিত সৌদি আরব। কিন্তু হাজার হাজার বছরের সেই ঐতিহ্য থেকে ক্রমেই বেরিয়ে আসছে দেশটি। এক্ষেত্রে একেবারে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন দেশটির যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান।
সৌদির আদি ইসলামী ঐতিহ্যকে ‘কট্টরপন্থা’ আখ্যা দিয়েছেন। বিপরীতে দেশে ‘মধ্যপন্থী ইসলাম’ প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন তিনি। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘মধ্যপন্থা’র নামে তিনি আসলে পশ্চিমা ভাবধারা ও সংস্কৃতিকেই আমদানি করছেন।
বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ এখন নামেমাত্র সৌদি শাসক। প্রকৃত শাসন ক্ষমতা মোহাম্মদের হাতেই। ২০১৭ সালে ছেলেকে ক্রাউন প্রিন্স বা যুবরাজ ঘোষণা করেন বাদশাহ। সরিয়ে দেন ভাতিজাকে। ভবিষ্যৎ বাদশাহির পথ সুগম হওয়ায় পর্দার আড়াল থেকে সামনে চলে আসেন প্রিন্স সালমান।
সমাজ ও সংস্কৃতির ‘আধুনিকায়নে’ ভিশন-২০৩০ ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। সেই লক্ষ্যেই ইতিমধ্যে বহু নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়েছে। গাড়ি চালানো, হলে গিয়ে সিনেমা ও মাঠে গিয়ে খেলা দেখা এমনকি অভিভাবক ছাড়াই নারীদের হোটেলে কক্ষ ভাড়া নেয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি দেশটির বিভিন্ন বড় কনসার্টেরও আয়োজন করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়, যা নিয়ে সারাবিশ্বে সমালোচনা চলছে।
সৌদি আরবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে এবার গুরুত্ব বাড়ছে বিনোদন শিল্পের। সদ্যই সৌদি আরবের সংগীত উৎসব ‘সাউন্ডস্টর্ম সংগীত উৎসব’ শেষ হলো। চারদিনের সংগীত উৎসবে সাত লাখের বেশি অতিথি অংশগ্রহণ করেছে। এর রেশ যেতে না যেতেই সৌদিবাসীর জন্য ‘নিউ ইয়ার’ এসেছিল বাড়তি আনন্দ হয়ে। বিশ্বের বিভিন্ন জনপদের মতো মহা ধুমধামে নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবও। জমকালো আয়োজন আর আতশবাজির রঙিন আলোর ঝলকানিতে ২০২২ সালকে স্বাগত জানিয়েছে সৌদিবাসী।
সৌদি আরবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে এবার গুরুত্ব বাড়ছে চলচ্চিত্র শিল্পের। সৌদি আরবে সিনেমা মুক্তিতে ৩৫ বছরের নিষেধাজ্ঞা উঠেছে মাত্র ৪ বছর হলো। তবে সংবেদনশীল ধর্মীয় বা রাজনৈতিক বিষয়, যৌনতা ও সমকামিতা স্পর্শ করে এমন সিনেমা দেশটিতে এখনো নিষিদ্ধ। পশ্চিম এশিয়ার সিনেমাগুলো সবচেয়ে বেশি মুক্তি পায় সেদেশে। বর্তমানে সৌদি আরবে ১৫৪টি সিনেমা হল চালু আছে।
গত শতক পর্যন্ত সৌদির ক্ষমতাসীন আল সৌদ পরিবার অনেকটা নিশ্চিন্তেই শাসনকার্য চালিয়ে গেছে। তাদের মূল ভরসা দেশটির বিপুল তেলসম্পদ। আর রক্ষণশীল ধর্মীয় নেতাদের সমর্থন। কিন্তু সময় বদলে গেছে। সৌদি আরবকে এখন একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে এখন তরুণদের জয়জয়কার। তাদের অবজ্ঞা করা কোনো শাসকের পক্ষেই সম্ভব না। তরুণদের উপেক্ষার পরিণতিতে মসনদও উল্টে যেতে পারে। সৌদি বাদশা সালমানকে দূরদর্শীই বলতে হয়। তিনি বাস্তবতা বুঝতে পেরেছেন। তারুণ্যকে গুরুত্ব দিয়ে তিনি তার ৩২ বছর বয়সী ছেলে মোহাম্মদ বিন সালমানকে ক্রাউন প্রিন্স করেছেন। সিংহাসনের এই উত্তরাধিকারী এখন সৌদির সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের প্রধান সারথি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮১৫
আপনার মতামত জানানঃ