বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসার ভবিষ্যৎ বেশ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। দেশে এখন ১৯ হাজারের বেশি কওমি মাদ্রাসা রয়েছে। এগুলোকে সরকারের নিবন্ধনের আওতায় আনা এবং এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রমের ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি সমন্বিত নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে।
তবে কওমি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সরকারের কাছে নিবন্ধনের প্রস্তাবে রাজি নয় বেসরকারি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের নেতৃত্ব। তারা বলেছেন, নিবন্ধনের আওতায় এনে সরকারের তদারকি বাড়ানো হলে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার স্বকীয়তা থাকবে না। সেজন্য তারা সরকারের কাছে নিবন্ধনে রাজি নন।
কেন নিবন্ধনের আওতায় আনতে চায় সরকার?
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা যাতে কর্মক্ষেত্রের জন্য যোগ্য এবং দক্ষ হয়ে গড়ে ওঠে, সেজন্য এই শিক্ষা কার্যক্রমকে যুগোপযোগী করার বিষয় সরকার বিবেচনা করছে।
কওমি মাদ্রাসা শিক্ষায় কোন শৃঙ্খলা নেই; এমন অভিযোগ বিভিন্ন সময়ই আলোচনায় এসেছে। এনিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনেও অনেক বিতর্ক হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও কওমি মাদ্রাসার কার্যক্রম খতিয়ে দেখে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কওমি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের বোর্ড এবং সরকারের কোন পর্যায়ের প্রশাসনের কোন অনুমতির প্রয়োজন হয় না। এছাড়া সুনির্দিষ্ট কোন নিয়ম বা নীতিমালাও নেই।
সরকারের একটি কমিটি খতিয়ে দেখেছে যে, শহর থেকে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত অনেক কওমি মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে কোনভাবে একটি ঘর ভাড়া করে। যেখানে শিক্ষার পরিবেশ নেই।
এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সরকার কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ দাওরায়ে হাদিস ডিগ্রিকে মাস্টার্স এর মর্যাদা দিয়েছে। এর ভিত্তিতে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন চাকরিতে প্রবেশের বা কর্মক্ষেত্র খুঁজে নেয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
সেকারণে এই শিক্ষাকে একটা নিয়মের মধ্যে আনতে নিবন্ধনের ব্যবস্থাসহ একটি সমন্বিত নীতিমালার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
সাধারণ শিক্ষা, ইংরেজী মাধ্যমসহ সব ধরনের শিক্ষার জন্য সরকার একটি শিক্ষা আইনের খসড়া তৈরি করেছে। সেই খসড়ায় কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়েও সুনির্দিষ্ট বিধান রাখা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বিবিসিকে বলেছেন, দেশের সার্বিকভাবে সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্যই কিছু নিয়ম থাকা প্রয়োজন।
শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বিবিসিকে বলেছেন, সরকার কওমি মাদ্রাসার স্বকীয়তা এবং সেই আইনকে সম্মান করে।
তবে তিনি বলেন,সরকার কোন নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায় না। সরকার চাইছে এই শিক্ষাকে যুগোপযোগী করতে।
মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, আমাদের জাতীয় পাঠক্রম আছে। সেই পাঠক্রম অনুযায়ী একটা বয়সসীমা পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের যে শিক্ষা লাভ করতে হয়, কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও যাতে সেই জাতীয় পাঠক্রমের শিক্ষা নিয়ে কর্মযোগ্য বা কর্মদক্ষ হয়-সেজন্য আমরা তাদের সাথে একসাথে কাজ করবো।
তিনি আরও বলেন, “শুধু ধর্মতত্ত্বের ওপর শিক্ষা নিয়ে তাদের কিন্তু কর্মযোগ্যতা হয় না। তার ফলে একটা বিশাল জনগোষ্ঠী সমস্যায় পড়ে যাচ্ছে।”
তাদের কর্মদক্ষতা না থাকায় তারা কোথাও চাকরি পাচ্ছে না। সেজন্যই আমরা তাদের শিক্ষা নিয়ে একসাথে কাজ করছি। এখানে নিয়ন্ত্রণ বা তদারকির কিছু নেই।
সরকার চাইছে, দশম শ্রেণির সমমর্যাদা পর্যন্ত কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের বাংলা, ইংরেজি এবং অংক যেন পড়ানো হয়।
নিবন্ধনে রাজি নয় কেন মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ?
কওমি মাদ্রাসাগুলোর সবচেয়ে বড় শিক্ষা বোর্ড বেফাক এর সভাপতি মাহমুদুল হাসান বিবিসিকে বলেছেন, তাদের সাথে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা আলোচনায় বসে সরকারের কাছে মাদ্রাসার নিবন্ধনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তারা সেই প্রস্তাবে রাজি হননি।
মাহমুদুল হাসান মনে করেন, তারা তাদের অবস্থানের ব্যাপারে সরকারকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, তাদের স্বকীয়তা রক্ষায় সরকার কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না বলে তাদেরকে জানানো হয়েছে এবং সরকারের কাছে নিবন্ধনের ব্যাপারে তাদের আর কিছু বলা হয়নি।
মাহমুদুল হাসান বলেন, সরকারের সরাসরি নিবন্ধনের ব্যবস্থা না থাকলেও কওমি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পর তাদের বেসরকারি মাদ্রাসা বোর্ডের কাছে নিবন্ধন করতে হয়।
তিনি বলেন, “বেসরকারিভাবে বেফাকসহ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড যেগুলো রয়েছে, কওমি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পর তাদের কাছে নিবন্ধন করতে হয়। এক বছর পর পর এই নিবন্ধনের তালিকাসহ প্রতিবেদন আমরা বেফাকের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে পেশ করি।”
তিনি দাবি করেন, কোন কওমি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পর তার নিবন্ধনের জন্য মাদ্রাসা বোর্ডের কাছে আবেদন করা হলে, তখন প্রতিষ্ঠাতা ও অর্থের যোগানের ব্যাপারে তথ্য নেয়া হয়। এছাড়া তাদের মাদ্রাসা বোর্ড আবেদনকারী মাদ্রাসা পরিদর্শন করে শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করে এবং এরপর তারা নিবন্ধন দিয়ে থাকেন।
এদিকে, সরকার যে এই শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার কথা বলছে, তা নিয়ে বেফাকসহ বেসরকারি মাদ্রাসা বোর্ডগুলোর নেতৃত্বের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মত আছে।
বেফাকের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, কওমি মাদ্রাসায় দশম শ্রেণির সমমর্যাদা পর্যন্ত শিক্ষার্থীদেরও বাংলা ইংরেজী এবং বাংলাদেশের ইতিহাস পড়ানোর উদ্যোগ তারা নেবেন।
বেফাকেরই আরেকজন কর্মকর্তা বলেছেন, কওমি মাদ্রাসা ভারতের দেওবন্দকে অনুসরণ করে। সেজন্য দেওবন্দের সিলেবাস অনুসরণ করেই বাংলাদেশেও কওমি মাদ্রাসার সিলেবাস নির্ধারণ করা হয়। এখানে পরিবর্তনের সুযোগ নেই বলে তারা অনেক আগেই সরকারকে লিখিতভাবে জানিয়ে দিয়েছেন।
উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী অবশ্য বলেছেন, সরকার যে পদক্ষেপ নেবে, তা কওমি মাদ্রাসা বোর্ডের সাথে আলোচনা করেই ঠিক করবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫০০
আপনার মতামত জানানঃ