করোনার সংক্রমণ থেকে সুস্থ হয়ে ওঠার এক বছর পরও নানা ধরনের জটিলতা থেকে যাচ্ছে। উচ্চ রক্তচাপ কিংবা ডায়াবেটিসের মতো অসংক্রামক রোগে আক্রান্তদের করোনা-পরবর্তী জটিলতায় ভোগার ঝুঁকি দুই থেকে তিন গুণ বেশি।
সম্প্রতি জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) করা গবেষণায় উঠে এসেছে এই তথ্য।
গবেষণার প্রাথমিক তথ্য পর্যালোচনা করে একটি সারসংক্ষেপ গত বৃহস্পতিবার আইইডিসিআরের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। তবে কবে থেকে এবং কতজন রোগীর ওপর এই গবেষণা চালানো হয়েছে, তা জানানো হয়নি।
যা জানা গেছে গবেষণা থেকে
গবেষণায় বলা হয়, করোনায় আক্রান্ত হলে প্রাথমিক পর্যায়ে জ্বর, সর্দি, হাঁচি, কাশি, গলাব্যথা, শ্বাসকষ্ট, স্বাদ-গন্ধের অনুভূতি লোপ পাওয়া, অবসাদ ও দুর্বলতার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। সুস্থ হওয়ার পরও বিভিন্ন ধরনের জটিলতা থেকে যেতে পারে।
দেশে করোনা সংক্রমণ থেকে সুস্থ হওয়ার তিন মাস পর ৭৮ শতাংশের শরীরে এ ধরনের জটিলতা দেখা যাচ্ছে। ছয় মাস পর ৭০ শতাংশ, ৯ মাস পর ৬৮ শতাংশ এবং এক বছর পরও ৪৫ শতাংশ উত্তরদাতা এ ধরনের জটিলতায় ভোগার কথা বলেছেন।
জরিপে বলা হয়, উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের করোনা-পরবর্তী উপসর্গের জটিলতায় ভোগার আশঙ্কা দুই থেকে তিন গুণ বেশি। ফলে উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের করোনা-পরবর্তী জটিলতা কমাতে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন জরুরি।
উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের মধ্যে যারা নিয়মিত ওষুধ সেবন করেন, তাদের করোনা-পরবর্তী জটিলতার ঝুঁকি ৯ শতাংশ কম। একইভাবে ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে নিয়মিত ওষুধ সেবনকারীদের করোনা-পরবর্তী জটিলতার ঝুঁকি প্রায় ৭ শতাংশ কমে যায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের গত বছরের আগস্টে করা এক গবেষণায় বলা হয়েছে, করোনার সংক্রমণমুক্ত হওয়ার তিন মাস পরও ৪০ শতাংশ রোগী নানা রকম শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন।
করোনামুক্ত হওয়ার পর চিকিৎসা নিতে আসা ৫০০ রোগীর তথ্য পর্যালোচনা করে কাশি, শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা, নাকে গন্ধ কম পাওয়া, নাক দিয়ে রক্ত পড়া, কিডনি, লিভার, নিউরোজনিত সমস্যাসহ ৪০ শতাংশ রোগীর নানা রকম শারীরিক জটিলতা পাওয়া গেছে। বয়স্কদের মধ্যে এই জটিলতা সবচেয়ে বেশি।
খ্যাতনামা বিজ্ঞান সাময়িকী নেচারের এক প্রবন্ধে করোনা সংক্রমণের ফলে দীর্ঘ মেয়াদে শরীরের কোন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শ্বাসতন্ত্র।
এর ফলে কাশি, শ্বাসকষ্ট ও রক্তে অক্সিজেনের স্বল্পতা তৈরি হচ্ছে। স্ট্রোক, মাথাব্যথা, স্মরণশক্তি কমে যাওয়া, স্বাদ ও ঘ্রাণের সমস্যা, উদ্বেগ ও ঘুমের সমস্যা, নতুন করে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, স্থূলতা ও কোলেস্টেরল বেড়ে যাওয়া, তীব্র হৃদযন্ত্রের সমস্যা, হার্ট ফেইলিওর, ধড়ফড়ানি ও অনিয়ন্ত্রিত হৃদস্পন্দন, কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া, তীব্র কিডনি সমস্যা, শরীরে র্যাশ ওঠা ও চুল পড়া, ফুসফুসে রক্ত জমাট বাঁধা, অস্থিসন্ধিতে ব্যথা ওই প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, করোনা সংক্রমিত হওয়ার পর যেসব জটিলতা দেখা দেয়, তা কাটিয়ে উঠতে অনেকের সময় লাগে। আবার কেউ কেউ দ্রুত সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারেন। এটি নির্ভর করে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর।
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, করোনা সংক্রমণ থেকে সুস্থ হলেও সংক্রমিত ব্যক্তির নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ঘুম না হওয়া, বুকে ব্যথা, হৃদযন্ত্রে সমস্যা, ক্ষুধা কমে যাওয়া, স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, মানসিক সমস্যা এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এ জন্য করোনা-পরবর্তী জটিলতা দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ সেবন করতে হবে।
ডা. সাইদুল বলেন, করোনা-পরবর্তী জটিলতা নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের জটিলতা ও অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে আক্রান্ত বেশি পাওয়া যাচ্ছে। শ্বাসকষ্ট নিয়ে আসা ব্যক্তিদের করোনা সংক্রমিত হওয়ার আগে এ সমস্যা ছিল না। করোনা সংক্রমণে ফুসফুস মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তাদের এ সমস্যা দেখা দিয়েছে। এ ধরনের রোগীদের দীর্ঘ মেয়াদে ওষুধ সেবন করতে হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, অধিকাংশ রোগী করোনা-পরবর্তী জটিলতা নিয়ে আমার কাছে আসছেন। কারও শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের জটিলতা ও অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস আছে। আবার কারও কিডনি, লিভার, নিউরো, উচ্চ মানসিক চাপ, উচ্চ রক্তচাপ, অনিদ্রা, খাবারে অরুচি ও দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে। অধিকাংশ রোগী দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। এ কারণে সুস্থতার জন্য ফলোআপে থাকতে হবে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, করোনা সংক্রমণের পর মানসিক রোগের চিকিৎসা নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে বেশির ভাগই করোনা সংক্রমিত কিংবা তাদের স্বজনরা সংক্রমিত ছিলেন। কারণ, করোনার প্রভাব বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ওপর নানাভাবে পড়েছে। দীর্ঘদিন আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইনে থেকে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে না পারায় কেউ কেউ দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। চলমান মহামারি শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সী মানুষকে নতুন করে মানসিক সংকটে ফেলেছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫১৮
আপনার মতামত জানানঃ