বাংলাদেশ এবং দুর্নীতি; যেন একে অন্যের পরিপূরক। সম্প্রতি গ্লোবাল ব্রাইবারি রিস্ক ইনডেক্স কান্ট্রি র্যাঙ্কিং ২০২১ প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবছর ‘ট্রেইস ইন্টারন্যাশনাল’ নামের আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা এ সূচক প্রকাশ করে। ২০২১ সালের র্যাঙ্কিংয়ে ১৯৪টি দেশ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৭ নম্বরে। এই দুর্নীতির কারণেই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুবিধা ভোগ করতে পারছে না দেশের সাধারণ মানুষ।
টিআই’র দুর্নীতির ধারণা সূচকে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে ২০০৯ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৩তম, ২০১০ সালে ১২তম, ২০১১ সালে ১৩তম, ২০১২ সালে ১৩তম, ২০১৩ সালে ১৬তম, ২০১৪ সালে ১৪তম, ২০১৫ সালে ১৩তম, ২০১৬ সালে ১৫তম, ২০১৭ সালে ১৭তম এবং সর্বশেষ ২০১৮ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম৷
আওয়ামী লীগ যেভাবে দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষক
বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হয়েই অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে দুদককে অকার্যকর করার যাবতীয় প্রয়াস জোরদার করেছে। অথচ ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত এক যুগে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পালে প্রবল হাওয়া লেগেছে।
দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে বাড়তে বাড়তে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। করোনাভাইরাসের তাণ্ডবে ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার কমে গেলেও তা ধনাত্মক রয়ে গেছে, যেটা ভারতের ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির তুলনায় অবশ্যই প্রশংসনীয়।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফলের সিংহভাগ দেশের ধনাঢ্যদের কাছে গিয়ে জমা হয়ে যাচ্ছে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ন্যায্য হিস্যা থেকে দেশের সাধারণ জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে ক্ষমতাসীন মহলের ভ্রান্ত নীতির কারণে।
কিন্তু দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের সর্বনাশা বিস্তৃতির কারণে জিডিপির প্রবৃদ্ধির এ সাফল্যের সুফল যে সমাজের কয়েক হাজার ব্যবসায়ী-শিল্পপতি, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, দুর্নীতিবাজ আমলা এবং দুর্নীতিতে নিমজ্জমান সামরিক কর্মকর্তারাই একতরফা দখলে নিয়ে যাচ্ছেন, তারই অকাট্য প্রমাণ ফুটে উঠেছে ২০১৮ সালে বাংলাদেশের আরেকটি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জনের মাধ্যমে ধনাঢ্য ব্যক্তি সৃষ্টির প্রতিযোগিতায় ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে বার্ষিক ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার অর্জন করেছে বাংলাদেশ, যেটা বিশ্বের সর্বোচ্চ হার।
এটি বাংলাদেশের জন্য একটি লজ্জাজনক অর্জন। কারণ, ধনকুবেরদের সম্পদের প্রবল স্ফীতির অর্থই হলো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফলের সিংহভাগ দেশের ধনাঢ্যদের কাছে গিয়ে জমা হয়ে যাচ্ছে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ন্যায্য হিস্যা থেকে দেশের সাধারণ জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে ক্ষমতাসীন মহলের ভ্রান্ত নীতির কারণে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চারটি মূলনীতির মধ্যে ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র পুনঃস্থাপিত হয়েছে। ২০১১ সালে পাস হওয়া সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ক্ষমতাসীন মহাজোট সে রায়কে সংবিধানে ফিরিয়ে আনলেও বর্তমান সরকার এখনো ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’ এবং ‘ক্রনি ক্যাপিটালিজম’-এর মধ্যেই ডুবে আছে।
এ হতাশাজনক বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জনের পরও দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেশের শীর্ষ নেতৃত্বের টনক নড়ছে না। দেশের বর্তমান সাংসদদের ৬২ দশমিক ৭ শতাংশ ব্যবসায়ী, সরকারের মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্য ব্যবসায়ী।
একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আয়বৈষম্য এভাবে বাড়তেই পারে না। ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রায় ১৩ বছর হয়ে গেলেও আওয়ামী লীগ এ দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সদিচ্ছা দেখায়নি। অথচ ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির প্রতি ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করেছিলেন। ফলে সরকারি দলের সব স্তরের নেতা-কর্মীদের একটা বড় অংশই লুটেরা পুঁজির ফায়দাভোগী হয়ে ‘আঙুল ফুলে কলাগাছের’ রূপ ধারণ করেছে।
বাংলাদেশের দুর্নীতির কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অঙ্গীকারের সঙ্গে বাস্তবায়নের মিল না থাকা, হাইপ্রোফাইলদের দুর্নীতি চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় না আনা, আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতে ঋণ খেলাপি ও জালিয়াতি বৃদ্ধি, ভূমি-নদী-খালবিল দখল, টেন্ডার ও নিয়োগে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ না কমা, অবৈধ অর্থের লেনদেন বন্ধ না হওয়া, দুর্বল জবাবদিহিতা, দুদকের কার্যকারিতা ও স্বাধীনতার অভাব, অস্বীকারের সংস্কৃতি, দায়মুক্তি ও দুর্বল আইনের শাসন, গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের ক্ষেত্র সংকুচিত করা ইত্যাদি৷ তবে সবথেকে বড় ভূমিকা পালন করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার।
দুর্নীতিতে বাংলাদেশের দিগ্বিজয়
সাম্প্রতিক সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে ঘুষের ঝুঁকির বিচারে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় সর্বনিম্ন (মানে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত), আফগানিস্তানের অবস্থান সর্বনিম্ন ১৭৪ নম্বরে।
পাকিস্তানের অবস্থান তৃতীয় সর্বনিম্ন ১৫০ নম্বরে, মালদ্বীপের অবস্থান ১১৮ নম্বরে, নেপাল ১১২ নম্বরে, শ্রীলঙ্কা ৯২ নম্বরে, ভারত ৮২ নম্বরে ও ভুটান ৬২ নম্বরে। এর মানে ঘুষ দেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে নির্ণীত হয়েছে, আফগানিস্তান সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত। ভুটান দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ।
এর আগে বার্লিনে অবস্থিত দুর্নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স ২০২০ প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে বিশ্বের ১৭৯টি দেশের দুর্নীতির র্যাঙ্কিং প্রদত্ত হয়েছে। ১৭৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৬, পাকিস্তানের অবস্থান ১২৪, নেপালের ১১৭, শ্রীলঙ্কার ৯৪ ও ভারতের ৮৬। এ সূচক অনুসারেও দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ আফগানিস্তান, যার অবস্থান ১৬৫ নম্বরে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের গবেষণা মোতাবেক দুর্নীতিতে বাংলাদেশ পাঁচবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ২০০১-২০০৫ সাল পর্যন্ত। ২০০১ সালে সরকারে ক্ষমতাসীন ছিল আওয়ামী লীগ আর ২০০২ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন ছিল বিএনপি-জামায়াত জোট।
২০০৭-২০০৮ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুর্নীতিবাজদের ‘প্রবল ঝাঁকি’ দেওয়ায় বাংলাদেশের ভাগ্যে দুর্নীতির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ আর না জুটলেও আমাদের অবস্থান এখনো দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় সর্বনিম্ন এবং বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত ৩০ থেকে ৩৫টি দেশের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৫৮
আপনার মতামত জানানঃ