অবশেষে ঔপনিবেশিকতা ও দাসত্বের সব শৃঙ্খল ঝেড়ে ফেলল বার্বাডোজ। জন্ম নিল বিশ্বের প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে। যার মধ্য দিয়ে অবসান ঘটল ৪০০ বছরের রাজতন্ত্রের। আজ মঙ্গলবার থেকে আর ক্ষুদ্র ক্যারিবীয় দেশটির রাষ্ট্রপ্রধান থাকছেন না রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ।
সরে গেল ব্রিটেনের রাজকীয় পতাকাও। দেশটির ৫৫তম স্বাধীনতা দিবসে উঠল তাদের নিজস্ব পতাকা। রাজপরিবারের পক্ষ থেকে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গেছেন প্রিন্স চার্লস।
বার্বাডোজের প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ডেম স্যান্ড্রা মেসন। তিনি এর আগে বার্বাডোজের গভর্নর জেনারেল ছিলেন। তিনি সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ও বিচারপতি এবং চারটি দেশের রাষ্ট্রদূত হিসাবেও কাজ করেছেন।
মধ্যরাত পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন এই প্রজাতন্ত্রের জন্ম হয়। রাজধানী ব্রিজটাউনের চেম্বারলেইন ব্রিজে সারিবদ্ধ শত শত মানুষের হর্ষধ্বনি দিয়ে এ জন্মকে স্বাগত জানায়। হিরোস স্কয়ারে জড়ো হওয়া জনতার সামনে জাতীয় সংগীত বাজানো হয়, এরপর ২১ বার তোপধ্বনি করা হয়।
দ্বীপ দেশটির রাজতন্ত্র থেকে প্রজাতন্ত্রে ঐতিহাসিক রূপান্তরকে চিহ্নিত করার আনুষ্ঠানিক উৎসবের জন্য রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে ন্যাশনাল হিরোস স্কোয়ারকে জাতীয় রঙ সোনালী ও মেরুনে সজ্জিত করা হয়েছিল। ব্রিটিশ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী প্রিন্স চার্লস এই অনুষ্ঠানের জন্য লন্ডন থেকে এসেছিলেন এবং রাজকীয় পতাকাটি নামানো এবং তার জায়গায় দেশটির নতুন পতাকা উত্তোলনের সাক্ষী থাকেন।
এর পরে, রানির নিজের সাবেক প্রতিনিধি, গভর্নর-জেনারেল ও সাবেক আইনজ্ঞ ৭৩ বছর বয়সী স্যান্ড্রা ম্যাসন প্রধান বিচারপতির দ্বারা প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন৷ বার্বাডোজ ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করার ঠিক ৫৫ বছর পর এই অনুষ্ঠানটি আয়োজিত হয়।
ম্যাসন প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার প্রথম ভাষণে বলেন, ‘আমরা কে এবং আমরা কী অর্জন করতে পারি, ২০২১ সালে, আমরা এখন নতুন প্রজাতন্ত্রের দিকে আমাদের জাহাজের ধনুক ঘুরিয়ে দিই। আমরা এটি করি যাতে আমরা আমাদের সার্বভৌমত্বের সম্পূর্ণ উপাদান দখল করতে পারি। দশক ধরে, আমরা বার্বাডোজের প্রজাতন্ত্রে রূপান্তর নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক করেছি। আজ, বিতর্ক এবং বক্তৃতা কর্মে পরিণত হয়েছে। আজ, আমরা আমাদের জন্য একটি নতুন দিকনির্দেশ করেছি।’
বার্বাডোজের প্রজাতন্ত্রের ধারাকে সমুন্নত রাখার আহ্বান জানিয়ে দেশটির দায়িত্ব নেওয়া প্রথম প্রেসিডেন্ট সান্দ্রা ম্যাসন বলেন, “আমাদের দেশের ভবিষ্যত আমাদেরই গঠন করতে হবে। আমরা বারবেডোজের জনগণই আমাদের জাতির রক্ষক।”
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্রিটিশ রানির রাজকীয় পদবি বাতিল করে নতুন বার্বাডোজের ঘোষণা দেওয়ার সময় ব্রিটিশ সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী প্রিন্স চার্লস সেখানে নিস্তব্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
মধ্যরাত পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন এই প্রজাতন্ত্রের জন্ম হয়। রাজধানী ব্রিজটাউনের চেম্বারলেইন ব্রিজে সারিবদ্ধ শত শত মানুষের হর্ষধ্বনি দিয়ে এ জন্মকে স্বাগত জানায়। হিরোস স্কয়ারে জড়ো হওয়া জনতার সামনে জাতীয় সংগীত বাজানো হয়, এরপর ২১ বার তোপধ্বনি করা হয়।
ঐতিহাসিক মুহূর্তটি স্মরণীয় করে রাখার জন্য ২১ বার গোলাবর্ষনের পরে ম্যাসন প্রিন্স অফ ওয়েলসকে দেশের সর্বোচ্চ সম্মান, অর্ডার অফ ফ্রিডম প্রদান করেন। যা ছিল বার্বাডোজ এবং যুক্তরাজ্যের মধ্যে অব্যাহত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে তুলে ধরার জন্য একটি পদক্ষেপ।
অনুষ্ঠানে প্রিন্স চার্লস বলেন, ‘এই প্রজাতন্ত্রের সৃষ্টি একটি নতুন সূচনা দেয়। আমাদের অতীতের অন্ধকার দিনগুলো এবং দাসত্বের ভয়ঙ্কর নৃশংসতা থেকে, যা আমাদের ইতিহাসকে চিরকাল কলঙ্কিত করে রেখেছে। এই দ্বীপের লোকেরা অসাধারণ দৃঢ়তার সাথে তাদের পথ তৈরি করেছিল। মুক্তি, স্ব-শাসন এবং স্বাধীনতা ছিল আপনাদের লক্ষ্য। স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার এবং আত্ম-সংকল্প আপনাদের পথপ্রদর্শক হয়েছে।’
প্রাণবন্ত উদযাপন অনুষ্ঠানে বার্বাডিয়ান সঙ্গীত এবং নৃত্যও প্রদর্শন করা হয়। তবে অনেকের কাছে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল যখন গায়িকা রিহানাকে জাতীয় বীর ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণায় জনতার বিশাল গর্জন করে আনন্দ প্রকাশ করে।
বার্বাডোজের রাজধানী ব্রিজটাউনে প্রজাতন্ত্রের উদযাপনের সময় এ ঘোষণা দেন সে দেশের প্রধানমন্ত্রী মিয়া মটলি। সবার সামনে রিয়ানাকে অভিবাদনও জানান তিনি।
২০১২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত রিহানার ‘ডায়মন্ডস’ (হীরা) গানের প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী মটলি বলেন, “আপনি হীরার মতো দ্যুতি ছড়াতে থাকুন এবং আপনার কাজ দিয়ে জাতির জন্য আরও সম্মান বয়ে আনুন।”
প্রসঙ্গত, বার্বাডোজ থেকে আসা পপ তারকা রবিন ‘রিয়ানা’ ফেন্টি এখন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী সংগীতশিল্পীদের একজন। গত আগস্টে ফোর্বস সাময়িকীর করা একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৩৩ বছর বয়সী এই পপ তারকার মোট আনুমানিক সম্পদের পরিমাণ ১.৭ বিলিয়ন ডলার।
২০১৬ প্রকাশিত তার অ্যালবাম ‘অ্যান্টি’ ৬৩ সপ্তাহ ধরে বিলবোর্ড চার্টগুলোতে ছিল।
পরবর্তীতে তিনি কসমেটিক ব্র্যান্ড ‘ফেন্টি বিউটি’ এবং অন্তর্বাসের ব্র্যান্ড ‘স্যাভেজ এক্স ফেন্টি’র মাধ্যমে ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য গড়ে তোলার জন্য সময় ব্যয় করেন।
বুস্টক অ্যাডভাইজারের সহ-প্রতিষ্ঠাতা শ্যানন কোয়েনের মতে, রিয়ানার সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি হলো সব রকমের আকার, গড়ন, এবং বর্ণের নারীদের জন্যে পণ্য বাজারজাত করা।
বার্বাডোজ রাষ্ট্রপ্রধানের পদ থেকে অপসারণ করলেও রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ এখনও যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও জ্যামাইকাসহ আরও ১৫টি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মর্যাদায় বহাল রয়েছেন।
এই প্রজাতন্ত্র একটি নতুন দিগন্তের সূচনা জানিয়ে প্রিন্স চার্লস বলেন, তার মা (রানি এলিজাবেথ) বার্বাডোজ জনগণকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
প্রায় ৪০০ বছর আগে ১৫২৫ সালে প্রায় চার হাজার মাইল দূরের ক্যারিবীয় দ্বীপটিতে ভেড়ে ইংরেজদের প্রথম জাহাজটি। এরপর শুরু হয় চার শতকের ঔপনিবেশিকতা আর দাসত্বের ইতিহাস। আফ্রিকা থেকে কৃষ্ণাঙ্গ দাস এনে আখ চাষ করানোই ছিল ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের লক্ষ্য। ২০০ বছরের মাথায় ছয় লাখ আফ্রিকান দাসের ঠাঁই হয় বার্বাডোজে। ১৮৩৬ সালে সেই দাসত্ব প্রথা অবলুপ্ত হয়। কিন্তু স্বাধীনতা আসেনি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশ ছিল দেশটি। রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ১৯৬৬ সালে স্বাধীনতা পায় দ্বীপটি। তৈরি হয় প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও গভর্নর জেনারেলের মতো পদ। এর পরও রাষ্ট্রপ্রধানের পদে ছিল ব্রিটেনের রানি এলিজাবেথের নাম। সরাসরি না হলেও কাগজ-কলমে দেশটির সব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করত ব্রিটেনের রাজপরিবার ও তাদের প্রতিনিধি।
সিএনএন জানিয়েছে, সোমবার পর্যন্তও বার্বাডোজসহ ১৬টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন রানি এলিজাবেথ। বার্বাডোজ বেরিয়ে যাওয়ার পর এখন তার ঝুলিতে থাকবে আর মাত্র ১৫টি রাজ্য। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা ও জ্যামাইকার মতো দেশগুলো এই তালিকায় রয়েছে। তবে এই দেশগুলোর নাগরিকেরাও নতুন করে ভাবতে শুরু করেছে।
বার্বাডোজের আগে রাষ্ট্রপ্রধানের জায়গা থেকে রানি এলিজাবেথের নাম বাতিল করে ভারত মহাসাগরের ক্ষুদ্র দ্বীপ দেশ মরিশাস। বিশ্বে এখন পর্যন্ত বিশ্বের ১৫০টি দেশ স্বাধীন প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। যার শুরু হয় ইউরোপের নেদারল্যান্ডসের মধ্য দিয়ে। প্রায় সাড়ে ৪০০ বছর আগে রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের স্পেন থেকে স্বাধীন হয় দেশটি। রক্তক্ষয়ী লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৭৭৬ সালে ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। রাজতন্ত্রের বিলোপ করে ১৯১১ সালে নিজেকে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা দেয় চীন। বিখ্যাত জার্মান বিপ্লবের মাধ্যমে সম্রাট দ্বিতীয় উইলিয়ামকে উৎখাত করে প্রজাতন্ত্র হয় জার্মানি। সর্বশেষ ২০০৮ সালে রাজতন্ত্র বিলোপ করে এশিয়ার দেশ নেপাল।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৪০
আপনার মতামত জানানঃ