চিত্রনায়িকা পরীমণিকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা রিমান্ডে পাঠানো নিম্ন আদালতের দুই বিচারকের ব্যাখ্যায় হাইকোর্ট ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ওই ব্যাখ্যা হাইকোর্টকে আন্ডারমাইন (হেয়) করেছে বলে দাবি আদালতের।
পরীমণির রিমান্ডের নেওয়ার বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাদের হাজিরা ও বিচারকদের ব্যাখ্যার বিষয়ে শুনানিকালে আজ বুধবার (১৫ সেপ্টেম্বর) বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ার কাজলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ অসন্তোষ প্রকাশ করেন।
আদালতে পরীমণির পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট জেড আই খান পান্না ও মো. মুজিবুর রহমান। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবু ইয়াহিয়া দুলাল ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মিজানুর রহমান।
হাইকোর্ট বলেন, দুই ম্যাজিস্ট্রেট তাদের ব্যাখ্যায় বলেছেন, রাষ্ট্র মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখিয়েছে। পরীমণি বিদেশি মদ, আইস ও এলএসডিসহ গ্রেপ্তার হয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র সম্প্রতি এলএসডি গ্রহণ করে আত্মহত্যা করেছেন। উনারা (দুই ম্যাজিস্ট্রেট) উপরোক্ত বিষয়ে কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি হলে সরল বিশ্বাসে ভুল বলে দাবি করেছেন।
হাইকোর্ট বলেন, তারা রিমান্ডে নেয়ার ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের গাইডলাইনকে লঙ্ঘন করেছে। তাদের জবাবে আমরা সন্তুষ্ট না। তারা তাদের ভুল স্বীকার করে না। তারা এ জবাব দাখিলের মাধ্যমে হাইকোর্টকে আন্ডারমাইন করেছে। এ বিষয়ে ২৯ সেপ্টেম্বর আদেশ দেয়া হবে।
এ সময় মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তাও আদালতে যুক্ত ছিলেন। তাকে হাজিরা থেকে অব্যাহতির আবেদন জানালে তা নাকচ করে আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর আইওকেও হাজির থাকতে বলা হয়েছে।
বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি লে. এম জাহিদ সারোয়ার কাজলের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চে এ আদেশ দিয়েছেন।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দায়ের করা মামলায় চিত্রনায়িকা পরীমনির দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা রিমান্ড মঞ্জুর করায় হাইকোর্টে ক্ষমাও চেয়েছেন দুই বিচারক।
ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক দেবব্রত বিশ্বাস এবং আতিকুল ইসলাম এই সপ্তাহে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ে ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন করে পৃথক পৃথকভাবে দুটি লিখিত ব্যাখ্যা জমা দিয়েছেন।
এর আগে গত ১ সেপ্টেম্বর চিত্রনায়িকা পরীমণির দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা রিমান্ডের যৌক্তিকতা নিয়ে অধস্তন আদালতের দুই ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ব্যাখ্যা জানতে চান হাইকোর্ট।
১০ দিনের মধ্যে এই ব্যাখ্যা দাখিলের নির্দেশ দিয়ে হাইকোর্ট বলেন, রিমান্ড মঞ্জুরকারী ঢাকার সংশ্লিষ্ট মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটরা কি উপাদানের ভিত্তিতে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন এর ব্যাখ্যা জানাতে হবে। এছাড়া মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) সিআইডি পুলিশের পরিদর্শক কাজী গোলাম মোস্তফাকে ১৫ সেপ্টেম্বর মামলার নথিসহ (কেস ডকেট) আদালতে হাজির হতে বলা হয়।
পরীমণির বারবার রিমান্ডে নেয়ার আবেদনের বিষয়ে তার অবস্থান সেদিন হাইকোর্টকে জানাতে বলা হয়। ওই আদেশ অনুযায়ী গতকাল মঙ্গলবার দুই ম্যাজিস্ট্রেট তাদের ব্যাখ্যা হাইকোর্টের কাছে দাখিল করেন। আজ বুধবার এ বিষয়ে শুনানি হয়।
বনানীতে পরীমণির বাসায় অভিযান চালিয়ে ৪ আগস্ট তাকে আটক করা হয়। পরে বনানী থানায় পরীমণির নামে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করে র্যাব। এরপর প্রথম দফায় গত ৫ আগস্ট চারদিন তাকে রিমান্ডে নেয়া হয়। দ্বিতীয় দফায় রিমান্ডে নেয়ার আবেদন জানালে গত ১০ আগস্ট ঢাকা মহানগর হাকিম (মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট) দেবব্রত বিশ্বাস তার দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
সর্বশেষ তৃতীয় দফায় রিমান্ডে নেয়ার আবেদন জানালে গত ১৯ আগস্ট ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আতিকুল ইসলাম পরীমণির একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। মূলত দ্বিতীয় দফায় রিমান্ড মঞ্জুরকারী ম্যাজিস্ট্রেট দেবব্রত বিশ্বাস ও তৃতীয় দফায় রিমান্ড মঞ্জুরকারী ম্যাজিস্ট্রেট আতিকুল ইসলামের কাছে ব্যাখ্যা চান হাইকোর্ট।
জানা যায়, গত ১৯ আগস্ট পরীমণির জামিন আবেদন নাকচের বিরুদ্ধে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে জামিন আবেদন করেন। গত ২২ আগস্ট দায়রা জজ এ আবেদন শুনানির জন্য ১৩ সেপ্টেম্বর শুনানির দিন রাখেন। পরদিন ‘আর্লি হিয়ারিং’ বা নির্ধারিত সময়ের আগে শুনানি চেয়ে আবেদন করেন তার আইনজীবীরা। এতে ফল না পেয়ে ২১ দিন পর শুনানির দিন রাখার আদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে এবং অন্তর্বর্তীকালীন জামিন চেয়ে ২৫ আগস্ট হাইকোর্টে আবেদন করেন পরীমণি।
শুনানি নিয়ে ২৬ আগস্ট বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের নেতৃত্বাধীন এই বেঞ্চ রুল দেন। রুলে জামিন আবেদন শুনানির জন্য ১৩ সেপ্টেম্বর নির্ধারণ করে মহানগর দায়রা জজ আদালতের দেওয়া আদেশ কেন বাতিল করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। জামিন আবেদনের শুনানি দ্রুত তথা দুই দিনের মধ্যে করতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয় রুলে। সেই সাথে ১ সেপ্টেম্বর রুল শুনানির তারিখ রাখা হয়।
এরই মধ্যে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় পরীমণিকে তিন দফায় সাত দিন রিমান্ডে নেয়ার প্রেক্ষাপটে স্বতঃপ্রণোদিত রুল চেয়ে ২৯ আগস্ট একই বেঞ্চে একটি আবেদন দাখিল করে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।
আবেদনে বলা হয়, তিন দফায় সাত দিনের মধ্যে প্রথমে চার দিন, দ্বিতীয় দফায় দুদিন ও তৃতীয় দফায় পরীমণিকে এক দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। গুরুতর প্রকৃতির অপরাধের ক্ষেত্রে সাধারণত দীর্ঘসময় রিমান্ডে নেয়া হয়ে থাকে। জাতীয় নিরাপত্তা বা জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গুরুতর মামলায় আদালতের এত দিনের রিমান্ডের অনুমতি দিতে দেখা যায়।
পরীমণিকে এতদিনের রিমান্ডে নেয়া সংবিধানের চেতনা, মৌলিক অধিকার ও সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশনার (আটক ও রিমান্ড-সংক্রান্ত) লঙ্ঘন। ১ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট এ বিষয়ে শুনানি নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের ব্যাখ্যা তলব করেন এবং আইওকে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন।
পরীমনির গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলেন, হঠাৎ করেই ঢাকাই সিনেমার নায়িকা পরীমনিকে আটক করা হয়। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব অভিযান চালায় তার বাড়িতে। অভিযানের আয়োজন দেখে মনে হয়েছিল বিশাল মাদক ব্যবসায়ী, কালোবাজারী, খুনি কাউকে ধরা হচ্ছে। এরপর মিডিয়া ট্রায়ালে পরীমনির গ্রেফতারের সাথে গুলিয়ে ফেলা হয় রাজ, পিয়াসা, মৌ এবং হেলেনা জাহাঙ্গীরকে গ্রেপ্তারের ঘটনা।
মামলা হবার আগেই গ্রেফতার দেখানো হয় পরীমনিকে; মাদক মামলা। প্রচুর মদের বোতল পাওয়া গেছে বলে জানায় র্যাব। স্থানীয় গণমাধ্যম অনুযায়ী শুরু থেকেই মদ ছাড়াও অন্যান্য মাদক পাওয়া গেছে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে সুনির্দিষ্ট করে এই অভিযোগ জানায়নি পুলিশ কিংবা এরপর পরীমনিকে আরও নানা অভিযোগে জড়ানোর চেষ্টা করা হয়। যদিও সুনির্দিষ্ট প্রমাণের অভাব ছিল সব অভিযোগেই। এ অবস্থাতেও টানা তিনবার রিমান্ডে নেয়া এবং ২৮ দিনের কারাবাসের কারণ এখনও মূলত রহস্যই।
আপনার মতামত জানানঃ