আগস্টের মাঝামাঝিতে আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে তালিবান। মার্কিন নেতৃত্বাধীন আগ্রাসনে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার দুই দশক পর আবারো দেশটির নিয়ন্ত্রণ নেয় সশস্ত্র গোষ্ঠীটি। এর পরই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে দাঁড়ায় দেশটির ভঙ্গুর অর্থনীতি।
আফগানিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটকে এখনই গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা না হলে অচিরেই দেশটির জনগণ ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হতে পারেন। এমনকি দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯৭ শতাংশ মানুষ ২০২২ সালের মাঝামাঝি দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে পারেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার (৯ সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘ এই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা।
বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এক রিপোর্টে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) জানিয়েছে, আফগানিস্তানের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) দুর্নীতির কারণে দেশটিতে দারিদ্র্যের হার ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। আফগান ভূখণ্ডের অর্ধেক জনগোষ্ঠীরই এখন মানবিক সহায়তা প্রয়োজন বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি।
আফগানিস্তানে ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি আবদুল্লাহ আল দারদারি আলজাজিরাকে জানিয়েছেন, ‘বাজেট নিয়ে সমস্যা রয়েছে, রিজার্ভ নিয়ে সমস্যা রয়েছে। দেশের বাইরে সংরক্ষিত ৯০০ কোটি মার্কিন ডলারের রিজার্ভ যদি পুরোপুরি আটকে রাখা হয়, তাহলে আফগানিস্তানে বাণিজ্য নিয়েও সমস্যা সৃষ্টি হবে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক; উভয় বাণিজ্যেই সমস্যা হবে।’
তিনি আর বলেন, ‘কোনো দেশে এই (আফগানিস্তানের মতো) পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ-সহ দ্বিপাক্ষিক ও বহু-পাক্ষিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো জাতিসংঘের সঙ্গে সমন্বয় করে একত্রিত হয় এবং অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য একটি রূপরেখার প্রস্তাব করে। কিন্তু আফগানিস্তানে এমন কিছু হবে না।’
তবে আফগানিস্তানের এই পরিস্থিতি নতুন নয়। গত মাসে দ্রুততার সঙ্গে তালিবান পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার আগে থেকেই আফগানিস্তান ব্যাপকভাবে বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল। দেশটির মোট জিডিপিতে বিদেশি সাহায্যের অবদান এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি। এই পরিস্থিতিতে মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে যুক্ত থাকা কর্মীদের কাজের সুযোগ অব্যাহত রাখতে তালিবানের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে জাতিসংঘ।
আল দারদারি বলছেন, ‘সুশীল সমাজ ও স্থানীয় কমিউনিটি সংস্থাগুলোকে তাদের কাজ চালিয়ে যেতে দিতে হবে। তাদেরকে নিজেদের কাজ বাস্তবায়নের সুযোগ দিতে হবে। আমরা কিছু চাই না। শুধু তাদের কাজে বাধা দিবেন না।’
এর আগে চলতি মাসের শুরুতে আফগানিস্তানে মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তেনিও গুতেরেস। আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়, আগামী এক মাসের মধ্যে তীব্র খাদ্য সংকটে পড়তে পারে আফগানিস্তান। দেশটির প্রতি তিন জনে এক জন না খেয়ে থাকবে বলে আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ।
ফলে দেশটিতে জরুরি সহায়তা দেয়ার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি দেশটির মৌলিক সেবাসমূহ ও কর্মকাণ্ড পুরোপুরি ভেঙে পড়ার হুমকিতে রয়েছে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন তিনি।
সে সময় এক বিবৃতিতে গুতেরেস বলেন, অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন আফগান নারী, শিশু ও পুরুষদের আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা প্রয়োজন। এসময় তিনি আফগান নাগরিকদের জন্য অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদানেরও অঙ্গীকার করেন।
গুতেরেস আরও বলেন, ‘আফগানিস্তানের মানুষের এই প্রয়োজনের সময়ে প্রয়োজনীয় সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসতে আমি জাতিসংঘের সকল সদস্য দেশের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। দ্রুত ও সহজতর উপায়ে আফগানদের এই সহায়তা দেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি।’
এদিকে বিমানবাহিনীর বিমানে আফগানিস্তানে ত্রাণ সহায়তা পাঠিয়েছে পাকিস্তান। বিমানটি গত বৃহস্পতিবার আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে পৌঁছায়। রেডিও পাকিস্তান জানিয়েছে, আফগানিস্তানে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত মনসুর খান ত্রাণসামগ্রী গ্রহণ করেন।
ইসলামাবাদ থেকে পাঠানো ত্রাণসামগ্রী গ্রহণ করে রাষ্ট্রদূত মনসুর খান জানিয়েছেন, আগামীতে আফগান জনগণের জন্য ত্রাণ ও মানবিক সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। শুক্র ও শনিবার আরও দু’টি বিমানে কান্দাহার এবং খোস্ত শহরে ত্রাণসামগ্রী পাঠানো হবে।
পাকিস্তানের জাতীয় দৈনিক ডনের প্রতিবেদনে এই খবর জানিয়ে বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার ইসলামাবাদের পক্ষ থেকে পাঠানো ত্রাণসামগ্রীর মধ্যে রয়েছে দশ টন আটা, দেড় টন ঘি এবং বিপুল পরিমাণ ওষুধ। সীমান্ত দিয়েও ত্রাণ আসবে বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রদূত।
এর আগে আগস্ট মাসে জাতিসংঘের এক সিনিয়র কর্মকর্তা সতর্ক করেছেন, আফগানিস্তানে জাতিসংঘের খাদ্যের মজুদ চলতি মাসে শেষ হয়ে যেতে পারে। আফগানিস্তানে জাতিসংঘের মানবিক বিভাগের প্রধান রামিজ আলেকবরভের মতে, ৩ কোটি ৮০ লাখ জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই জানে না যে তারা প্রতিদিন খাবার পাবে কিনা।
তিনি বলেন, জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি সাম্প্রতিক সময়ে কয়েক হাজার মানুষের মধ্যে খাদ্য বিতরণ করেছে। তবে শীত ঘনিয়ে আসায় এবং খরা শুরুর সঙ্গে সঙ্গে দেশটির সবচেয়ে দরিদ্রদের খাদ্য সরবরাহ চালিয়ে যেতে অন্তত ২০ কোটি ডলার প্রয়োজন।
গত মাসে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বিসলি রাষ্ট্রক্ষমতার পালাবদলে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়া আফগানিস্তানের জনগণের জন্য আকাশপথে একটি ‘মানবিক সেতু’ স্থাপনে পাকিস্তানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৩১২
আপনার মতামত জানানঃ