সংগীত এমন এক জিনিস, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। খালি গলায় কিংবা কোনো যান্ত্রিক মাধ্যমে, কোনো না কোনোভাবে গানের সাথে আমরা আছিই। সাহিত্যিকদের ভাষায়, সংগীত মানুষের এক সহজাত আনন্দ, শিকড়, নাড়ীর টান। জগতের সমস্ত সৃষ্টিই জগতের মৌলিক গানের সুরে নিজেদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে থাকে। আর তাই সংগীত থেকে দূরে সরে যাওয়া মানে নিজের থেকেই দূরে সরে থাকা।
সংগীত মানুষের সহজাত মানসিক ক্রিয়াত্মক উপাদান। এমন কোন মানবগোষ্ঠী নেই, যাদের ভাষা এবং গান নেই। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি প্রকাশের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা তার কোষস্তরের জিনকোডে আছে। এই সূত্রে মস্তিষ্কে একটি বিশেষ ডিভাইস রয়েছে। একে বলা যায়, সংগীতের উপলব্ধি এবং প্রকাশের ডিভাইস। এই উপকরণ আছে বলেই মানুষ সংগীত সৃষ্টি করতে পারে এবং সংগীতকে ভালোবাসতে পারে। অর্থাৎ, সংগীত মানুষের সহজাত অধিকার যা থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকলে তার ভেতর মানবিক গুণাবলী চরম অস্তিত্ব সংকটে ভোগে।
আফগানিস্তান তালিবানের দখলে যাওয়ার পর আফগানদের ওপর তালিবান কী কী করতে পারে তার একটি অনুমান পূর্ব থেকেই ছিল। নারীদের অধিকার বঞ্চিত করার পাশাপাশি তালিকায় সংগীতও ছিল। তালিবানের মুখপাত্রের বক্তব্য থেকে সেটাই আবার প্রমাণিত হলো। আফগানিস্তানের মানুষ আবারও সংগীতের মত সহজাত অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে যাচ্ছে। আবারও আফগানিস্তানে নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছে সংগীত। তালিবান বাহিনী মুখে উদারনীতির কথা যতই বলুক না কেন, তারা তাদের নতুন শাসনেও আগের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। বাহিনীর মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ নিউইয়র্ক টাইমসকে এ তথ্য জানায় বলে বিবিসির খবরে বলা হয়।
গত মঙ্গলবার জাবিউল্লাহ বলেন, ‘ইসলামে সংগীত নিষিদ্ধ…তাই আশা করছি, আমরা লোকজনকে এ ধরনের কর্মকাণ্ড না করার বিষয়টি বোঝাতে পারব।’
নব্বইয়ের দশকে তালিবান শাসনকালে দেশটিতে সংগীত, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র কড়াভাবে নিষিদ্ধ ছিল। আর কেউ এই নিয়ম অমান্য করলে তাকে গুরুতর শাস্তি পেতে হতো।
কিন্তু ২০০১ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর হাতে তালিবান উৎখাত হলে দেশটিতে সংগীতচর্চার ব্যাপক প্রসার ঘটে। সেখানে প্রচুর কনসার্ট ও উৎসব হতো। এমনকি আফগানিস্তানে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মিউজিক প্রতিষ্ঠা হয়, সেখানে নানা অনুষ্ঠানও উদ্যাপন করা হয়। পাশাপাশি দেশটির সব নারী অর্কেস্ট্রা দেশে ও বিদেশে দেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন।
এদিকে কাবুলের আফগানিস্তান ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব মিউজিক-এর দরজা বন্ধ। স্কুলের শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং ফ্যাকাল্টিরা বাড়িতে। প্রাণভয়ে কাটছে এক একটি দিন। মিউজিক স্কুলের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তায়।
মিউজিক স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা আহমাদ সারমাস্ত অস্ট্রেলিয়ার গণমাধ্যম এনপিআর-এ দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘অস্ত্রধারীরা স্কুলে ঢুকে পড়েছে। স্কুলের গাড়ি চুরির চেষ্টা করেছে। বাদ্যযন্ত্রগুলো ভেঙে ফেলেছে।’
সারমাস্ত আরও বলেন, ‘সব অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কাবুলে সব দ্রুত বদলে যাচ্ছে।’
মিউজিক স্কুলের অনেক শিক্ষার্থী তাদের বাদ্যযন্ত্র বাড়িতে নিয়ে আসেনি ভয়ে, এমনটাই জানান সারমাস্ত। কারণ তালিবানরা ঘরে ঘরে গিয়ে তল্লাশি চালাতে পারে। ঘরে বাদ্যযন্ত্র পেলে সমস্যায় পড়তে হবে শিক্ষার্থীদের।
ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এবং ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব মিউজিক মার্চেন্টস এর আর্থিক সহায়তায় আফগানিস্তানের মিউজিক স্কুলটি খোলা হয়েছিল ২০১০ সালে। ছেলে ও মেয়েরা একই ক্লাসরুমে মিউজিক শিখে। শেখানো হয় আফগানিস্তানের মিউজিক এবং ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল।
আফগানিস্তান ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব মিউজিক-এর সফলতার গল্প অনেক। একাধিক শিক্ষার্থী বিশ্বের নানা যায়গায় পারফর্ম করেছে। আফগানিস্তানের সংগীতের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে বিশ্বকে।
আফগানিস্তানে সংগীত চর্চা করা খুবই ঝুঁকির ব্যাপার। বছরের পর বছর ধরে মিউজিসিয়ানদের হুমকি দেয়া হয়েছে, অপহরণ করা হয়েছে, মেরে ফেলা হয়েছে। ২০১৪ সালে আফগানিস্তান ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব মিউজিকের একটি কনসার্টে আত্মঘাতী বোমা হামলা হয়েছিল। দুইজনের মৃত্যু হয়েছিল, অনেকেই আহত হয়েছিলেন। প্রাণে বেঁচে গেলেও অনেকদিনের জন্য শ্রবণ ক্ষমতা হারিয়েছিলেন সারমাস্ত। মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে অপারেশনের মাধ্যমে বোমার স্প্রিন্টার সরাতে হয়েছিল। তবে সৌভাগ্যক্রমে কোনো শিক্ষার্থী নিহত কিংবা আহত হয়নি। তবে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল সবাই।
বিজ্ঞানীরা মানুষের উপর সংগীতের প্রভাব সম্পর্কে অনেক গবেষণা চালাচ্ছেন৷ সংগীত মানুষের আচরণ কীভাবে বদলে দিতে পারে, তার কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরছেন তারা।
চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কিছু সংগীত স্মরণীয় হয়ে আছে৷ সংগীতই চিত্রনাট্যে প্রায় অসহনীয় সাসপেন্স বা উত্তেজনার অনুভূতি এনে দেয়৷ সংগীত মনোবিজ্ঞানী হিসেবে প্রো. গ্যুন্টার রোটার বলেন, সংগীত যে শরীরের ৫০টি বিভিন্ন প্যারামিটার বা স্থিতিমাপ পরিবর্তন করতে পারে, সেটা পরিমাপ করা সম্ভব৷ সংগীত শোনার সময়ে মস্তিষ্কের তরঙ্গ, হৃদস্পন্দন, এমনকি কয়েকটি হরমোনও বদলে যায়৷
সংগীত কীভাবে ও কেন আমাদের প্রভাবিত করে এবং আমাদের অনুভূতির সঙ্গে জুড়ে যায়, মিউজিক সাইকোলজিস্ট হিসেবে গ্যুন্টার রোটার তা নিয়ে গবেষণা করছেন৷ তিনি বলেন, ভাষার সুরই সম্ভবত সংগীতের উৎস৷ ভাষার মধ্যে আবেগ থেকে মানুষ কিছুটা বার করে সংগীতের মধ্যে চালিত করেছে৷ আমরা সংগীতের মাধ্যমে মানুষের মনমেজাজ ও অবস্থা বদলে দিতে পারি৷ অন্তত কাগজেকলমে এমনটাই দাবি করা যায়৷
হোটেল-রেস্তোরাঁয় বেশিরভাগ সময়ে সংগীত চালু থাকে৷ আমরা কী খাচ্ছি, কত পরিমাণ খাচ্ছি এবং কত অর্থ ব্যয় করতে চাই, সংগীত সে সবের উপর প্রভাব ফেলে৷ যেমন ব্রিটেনের এক গবেষণা অনুযায়ী ক্লাসিকাল বা ধ্রুপদী সংগীত শুনলে অতিথিরা খাবারের জন্য দশ শতাংশ বেশি দাম দিতে প্রস্তুত থাকেন৷ এমনকি এমন সংগীতের অনুরাগী না হলেও মন উদার হয়ে উঠতে পারে৷
প্রো. রোটার অবশ্য মনে করেন, ক্লাসিকাল সংগীত আমাদের পছন্দ না হলেও সেই ধারা অনেক বেশি অর্থবহ ও খানদানি মনে হয়৷ সেই সংগীত শোনার সময় আমরা আশেপাশের পরিবেশের অনেক বিষয়ের মধ্যেও সেই বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাই৷
আমাদের পছন্দের সংগীত মস্তিষ্কের মধ্যে আনন্দের অনুভূতি জাগিয়ে তোলে৷ সংগীত যখন তথাকথিত ‘লিম্বিক সিস্টেম’-এ পৌঁছে যায়, তখন ডোপামিন নামের আনন্দের হরমোনের নিঃসরণ ঘটে৷ এর ফলে শুধু মনে আনন্দ আসে না, শরীরও অনেক শিথিল, কর্মক্ষম ও সক্রিয় হয়ে ওঠে৷ ফলে আমাদের কর্মক্ষমতার উপরও তার প্রভাব পড়ে৷
শুধু আমরা কেন, আমাদের পূর্বপুরুষেরাও তো একইভাবে গানে মজে ছিলেন। একবারও কি আপনি ভেবেছেন, এই গান, এই সুর এলো কোথা থেকে? ব্যস্ত ও গতিময় নাগরিক জীবনে এটা নিয়ে ভাববার সময় আপনার-আমার না হলেও প্রাচীন পৃথিবীর মানুষেরা কিন্তু এটা নিয়ে ঠিকই ভাবতো। সংগীতের যাত্রা শুরু জগত সৃষ্টির সাথেই। জগত থেকে মানুষ যেমন নিজেকে আলাদা করতে পারবে না, সংগীত থেকেও তাই।
সংগীত থেকে দূরে সরে গেলে মানুষের ভেতরে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যায়। মন মেজাজ আগ্রাসী হয়ে ওঠে। মানসিকভাবে জঙ্গি হয়ে ওঠে। যেকোনো অপরাধে তার বিবেক কখনোই বাধা দিতে পারে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আফগানিস্তানে গান বাজনা বন্ধ করে আফগানদের স্বাভাবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলে সেটা হবে আত্মঘাতী এক সিদ্ধান্ত। কেননা, কোনো জাতিই সংগীতের বাইরে বেঁচে থাকতে পারে না। প্রত্যেক জাতির যেমন ভাষা রয়েছে তেমনি রয়েছে তার কৃষ্টি-কালচার। আর এসব মুখ চেপে বন্ধ করা হলে সেটা হবে একটা জাতির আত্মহত্যা। তাছাড়া এই আধুনিক যুগে, সংগীতের রমরমা যখন চারদিকে সুর বাজিয়ে চলছে যেখানে আফগানিস্তানও রয়েছে, সেখানে গান বাজনা বন্ধ করা মোটেও ভালো সিদ্ধান্ত হতে পারে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৩৬
আপনার মতামত জানানঃ