রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়াটা অনেকটাই খাল কেটে কুমির আনার মতো হয়েছে বাংলাদেশের জন্য। রোহিঙ্গারা আজ বিভিন্ন কৌশলে বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে যাচ্ছেন। অবৈধভাবে তাদের নাম উঠছে ভোটার তালিকায়। অনেকে আবার একধাপ এগিয়ে আছে। টাকার বিনিময়ে ভুয়া তথ্য দিয়ে পাসপোর্ট তৈরি করছে। পাড়ি দিচ্ছে বিদেশে। সেখানেও স্বভাবতই নানা অপরাধের সাথে যুক্ত হচ্ছে তারা। বাংলাদেশি পাসপোর্ট থাকায় এভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে দেশের ভাবমূর্তি।
শুধু বিদেশ নয় দেশের মধ্যেও সৃষ্টি করছে অরাজকতা। কক্সবাজারে তারা নানা ধরনের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণের মতো কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। এর ফলে সেখানকার স্থানীয় বাংলাদেশিদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
প্রায় ৫৫ হাজার অবৈধ ভোটার
সূত্র মতে, টাকার বিনিময়ে সংঘবদ্ধ একটি দালাল চক্র রোহিঙ্গাদের জন্ম নিবন্ধন, চেয়ারম্যানের সনদসহ পাসপোর্ট এমনকি তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরিতে সহায়তা করছে।
প্রাথমিক তদন্তে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব পাওয়ার পেছনে জেলা নির্বাচন কমিশনের অফিস, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পুলিশ কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে।
ওই চক্রের সহযোগিতায় বাংলাদেশি নাগরিকত্ব নেয়া ৮৯৭ রোহিঙ্গার জাতীয় পরিচয়পত্র রাষ্ট্রীয় দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) হাতে এসেছে। অর্ধশত রোহিঙ্গাসহ ১০৬ জনকে আসামি করে ইতোমধ্যে ১৮টি মামলা দায়ের করেছে দুদকের চট্টগ্রাম অফিস। প্রাথমিক তদন্তে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব পাওয়ার পেছনে জেলা নির্বাচন কমিশনের অফিস, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পুলিশ কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে।
দুদক সূত্রে জানা যায়, নানা কৌশলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণ করছেন। সর্বশেষ কক্সবাজার সদরের ইসলামাবাদ ইউনিয়নে দুই শতাধিক রোহিঙ্গার নাম ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, এমন অভিযোগ পেয়ে অনুসন্ধানে নামে দুদক।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে নির্বাচন কমিশনের কয়েকটি ল্যাপটপ ব্যবহার করে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫৫ হাজার ব্যক্তিকে অবৈধভাবে ভোটার বানানো হয়েছে। যাদের বেশিরভাগই রোহিঙ্গা। ওই ঘটনায় চলতি বছরের জুন পর্যন্ত কক্সবাজারের স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ প্রায় ১০৬ জনকে আসামি করে মোট ১৮টি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
প্রাথমিক তদন্তে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব পাওয়ার পেছনে জেলা নির্বাচন কমিশনের অফিস, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও পুলিশ কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে
দুদকের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিষয়টি এখনও তদন্তাধীন। এখনও নাগরিকত্ব পাওয়া হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে চিহ্নিত করা যায়নি। ফলে তাদের নাগরিকত্ব বাতিলের বিষয়টি ঝুলে আছে। তবে তদন্তপর্যায়ে ৮৯৭ রোহিঙ্গার নাম এবং তাদের ঠিকানাসহ একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে।
ওই তালিকায় দেখা যায়, কক্সবাজার সদর উপজেলার ৩নং ইসলামাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের টেকপাড়ার ছয় রোহিঙ্গা, সিকদার পাড়ার পাঁচজন, পশ্চিম বোয়ালখালির পাঁচজন, পূর্ব বোয়ালখালির ৬২ জন, পূর্ব ইউছুপেরখিলের ১২ জন, পাহাশিয়াখালির দুজন, ইউছুপেরখিলের দুজন, হরিপুরের ২৯ জন, খোদাইবাড়ির ১৮ জন, আউলিয়াবাদের ৩৮৬ জন, ছৈইম্মা ঘোনার সাতজন, বর্মাপাড়ার ১৩ জন, পশ্চিম গজালিয়ার ১৫৯ জন, থানার পশ্চিমে একজন, বামবাগানের সাতজন, ছফুরার বাড়ির দুজন, খুশির শিয়ারের চারজন, মাস্টার পাড়ার তিনজন, কারাচি পাহাড়ের ১৭ জন, ধোয়াশিয়ার একজন, গজ্জন বগিচার একজন, ওয়াহেদর পাড়ার পাঁচজন, মধ্যম গজালিয়ার ৬০ জন, পূর্ব গজালিয়ার ৮৪ জন এবং গজালিয়ার দুজন রোহিঙ্গা রয়েছেন।
মামলা এবং দুদকের বক্তব্য
ভুয়া তথ্যের ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট দেওয়ার অভিযোগে মোট ১৮টি মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে পাসপোর্ট সংক্রান্ত মামলা ১৩টি। এখানে আসামি করা হয়েছে ৭২ জনকে। যার মধ্যে ৩৬ জন রোহিঙ্গা। ইতোমধ্যে ১০ রোহিঙ্গা বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। অবশিষ্ট ২৬ রোহিঙ্গার পাসপোর্ট বাতিল করা হয়েছে। এসব মামলায় বাদী হয়েছেন দুদকের উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন, মাহবুবুল আলম ও সুভাষ চন্দ্র দত্ত।
অর্থের বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার অভিযোগে এখন পর্যন্ত পাঁচটি মামলা দায়ের হয়েছে। মামলায় ১০ রোহিঙ্গাসহ মোট আসামি ৩৪ জন। আসামিদের মধ্যে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের পরিচালক ও চট্টগ্রামের সাবেক সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা খোরশেদ আলম, চট্টগ্রামের সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা কার্যালয়ের সাবেক উচ্চমান সহকারী মাহফুজুল ইসলাম, সাবেক অফিস সহায়ক রাসেল বড়ুয়া এবং সাবেক টেকনিক্যাল এক্সপার্ট মোস্তফা ফারুকের নাম রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক সচিব মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, যাদের নাগরিকত্ব নিয়ে সন্দেহ আছে, তাদের বিরুদ্ধেই তদন্ত চলছে। এর মধ্যে রোহিঙ্গারাও রয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের এনআইডি (জাতীয় পরিচয়পত্র) তৈরির কাজে ব্যবহৃত সাতটি ল্যাপটপ চুরি হয়। মূলত, সেখান থেকেই ঘটনার সূত্রপাত।
ভুয়া জাতীয়তা সনদপত্র ও জন্ম নিবন্ধন সনদ তৈরি করে ১৩ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট ও স্মার্ট কার্ড প্রস্তুতে সহযোগিতার অভিযোগে তিন পুলিশ পরিদর্শক ও নির্বাচন কর্মকর্তাসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা হয় গত ১৭ জুন।
তিনি আরও বলেন, অবৈধভাবে ৫৫ হাজার জনকে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে। এ অভিযোগের অনুসন্ধান ও তদন্ত চলমান। অনেকগুলো মামলাও হয়েছে। অবৈধ নাগরিকত্ব পাওয়া সবাইকে চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। এটি চিহ্নিত হলে প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।
পুলিশ জড়িত
দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব পাওয়ার পেছনে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রশাসনের লোকজনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তা না হলে ভুয়া নাম, পরিচয় দেখিয়ে এনআইডি, জন্মনিবন্ধন কিংবা পাসপোর্ট করা সম্ভব নয়। এরা দেশের শত্রু। এ বিষয়ে আরও অনেক মামলা হবে।
ভুয়া জাতীয়তা সনদপত্র ও জন্ম নিবন্ধন সনদ তৈরি করে ১৩ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট ও স্মার্ট কার্ড প্রস্তুতে সহযোগিতার অভিযোগে তিন পুলিশ পরিদর্শক ও নির্বাচন কর্মকর্তাসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা হয় গত ১৭ জুন।
পটুয়াখালীর পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র) এস এম মিজানুর রহমান, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের অফিসার ইনচার্জ (তদন্ত) মো. রুহুল আমিন, রংপুর ডিআইজি অফিসের পুলিশ পরিদর্শক প্রভাষ চন্দ্র ধর ও কুমিল্লা আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসের অতিরিক্ত আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মো. মোজাম্মেল হোসেনকে আসামি করা হয়। এসব কর্মকর্তা ঘটনাকালীন কক্সবাজার জেলায় কর্মরত ছিলেন।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৯৫০
আপনার মতামত জানানঃ