ভুতুড়ে বিল’ কথাটার অর্থ কাউকে বলে দিতে হয় না। বিদ্যুৎ, গ্যাস বা পানির মতো অপরিহার্য নাগরিক পরিষেবা গ্রহণ করতে গিয়ে দেশের মানুষ দীর্ঘদিন ধরেই ভুতুড়ে বিলের সঙ্গে পরিচিত। যা খরচ করা হয়েছে তারচেয়ে বাড়তি বা অতিরিক্ত বিলের এই ভোগান্তিকে তাই মানুষ ভুতুড়ে বিল বলে। কিন্তু করোনা মহামারীর কালেও যে দেশের মানুষকে ভুতুড়ে বিলের খপ্পরে পড়তে হবে সেটা বোধহয় কেউই আশা করেননি।
মহামারী করোনাভাইরাসের তাণ্ডবে একদিকে বিপর্যস্ত হয়েছে মানুষের জীবন-জীবিকা, অন্যদিকে ভোগান্তি বেড়েছে লাগামহীন ভুতুড়ে বিদ্যুৎ বিলের কারণে। মোটাদাগে যাকে বলে ‘মরার উপর খাঁড়ার ঘা’। বিদ্যুৎ বিভাগ ইউনিটের চেয়ে অতিরিক্ত বিল করে- এ অভিযোগ কমবেশি অনেক গ্রাহকেরই। তেমনি এক অভিযোগ থেকে জানা গেলো, ঘরে ব্যবহার করা হয় একটি বৈদ্যুতিক ফ্যান ও লাইট। নেই কোনো এসি, ফ্রিজ কিংবা টেলিভিশন। তারপরও গ্রাহকের বিদ্যুৎ বিল এসেছে ৭৮৪৩০ টাকা!
এমনই ভূতুড়ে বিদ্যুৎ বিলের খবর পাওয়া গেছে চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উজেলায়। বিদ্যুৎ বিভাগের লোকজনের খেয়ালীপনা আর দায়িত্ব অবহেলার কারণেই এমনটা হয়েছে বলে অভিযোগ ভূক্তোভোগী গ্রাহকের। তবে বৈদ্যুতিক গোলযোগকে দায়ী করছেন বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা। একইসাথে পাহাড়সমান এই বিল কিস্তিতে পরিশোধের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে গ্রাহককে।
জানা যায়, ফরিদগঞ্জ উপজেলার রূপসা দক্ষিণ ইউনিয়নের সাহেবগঞ্জ গ্রামের বেপারী বাড়ির গৃহবধূ রুমা আক্তারের বৈদ্যুতিক মিটারে ঘটেছে এই ভূতুড়ে কাণ্ড। তিনি চাঁদপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-০২ ফরিদগঞ্জ জোনাল অফিসের আওতাধীন পল্লী বিদ্যুতের মিটার ব্যবহার করেন। রুমা আক্তার গত পাঁচ বছর এই বৈদ্যুতিক মিটারটি ব্যবহার করে আসছেন। তিনি একটি ফ্যান ও একটি লাইট ও মোবাইল চার্জার ব্যবহার করতেন। এতে প্রতি মাসে তার বিল আসত এক শ থেকে দেড় টাকার মত। যা তিনি নিয়মিতভাবে পরিশোধও করে আসছেন।
কিন্তু চলতি বছরের মার্চ মাসের বিদ্যুৎ বিল পেয়ে চোখ তার চড়কগাছ। এ মাসে তার বিদ্যুৎ বিল এসেছে ৭৮ হাজার ৪৩০ টাকা। বিদ্যুতের এ বিল দেখে হতাশ রুমা আক্তার বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেও পাননি কোনো সমাধান। উপরন্তু বিলের পুরো টাকাই পরিশোধের নির্দেশ দেওয়া হয় তাকে।
পল্লীবিদ্যুৎ অফিসের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে না গিয়েই গ্রাহক রুমা আক্তারকে জানিয়ে দেয়, তার বাড়িতে সর্টসার্কিট হওয়ায় মিটারে বেশি বিদ্যুৎ খরচ হয়েছে। তাকেই ওই বিল পরিশোধ করতে হবে। তবে রুমা আক্তারের দাবি- বাড়িতে সর্টসার্কিট বা বিদ্যুতের কোনো দুর্ঘটনায় ঘটেনি।
ভুক্তভোগী রুমা আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামী দিনমজুর। আমরা কোনোরকম খেয়ে না খেয়ে দিন পার করি। প্রতি মাসে বিদ্যুৎ বিল আসে ১০০, ১২০ কিংবা ১৫০ টাকা। হঠাৎ মার্চ মাসে এসেছে ৭৮ হাজার ৪৩০ টাকা।’
তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘এতো টাকা কীভাবে বিল আসলো তা জানতে আমি বিদ্যুৎ অফিসে গিয়েছিলাম। সেখানকার স্যারেরা (পল্লীবিদ্যুৎ কর্মকর্তা) আমার সঙ্গে যে খারাপ ব্যবহার করছে, তা বলার ভাষা নেই। আমরা গরিব, তাই বলে কী মানুষ না? বিল দিতেই হবে বলে আমাকে অফিস থেকে নামিয়ে দিয়েছেন।’
রুমা বলেন, ‘ঘরে আমি একটা ফ্যান আর একটা এনার্জি বাল্ব চালাই। এতো বিল কী কারণে আমি দেব? গরিব মানুষ আমি এতো টাকা কোথায় পাবো? সরকারের কাছে আমি এর ন্যায়বিচার চাই।’
এ ব্যাপারে চাঁদপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর ফরিদগঞ্জ জোনাল অফিসে কর্মরত ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মুহাম্মদ নূরুল হোসাইন বলেন, এই বিল আসার পরে আমরা তার বাড়িতে গিয়ে তদন্ত করে দেখেছি। মূলত বৈদ্যুতিক সর্ট সার্কিটের কারণে এই বিদ্যুতের ইউনিট খরচ হয়েছে। যা তার মিটারের আওতায়। তাই মার্চ মাসে তার মিটারে এত টাকা বিল এসেছে। এতো টাকা এক সঙ্গে পরিশোধ সম্ভব নয় বলে তাকে আমরা সহনীয় পর্যায়ে কিস্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের নির্দেশ দিয়েছি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তির ভিত্তিতে বিতরণ কোম্পানিগুলো কাজ করে থাকে এবং একটা অর্থবছর ঘিরে তাদের লক্ষ্যমাত্রা থাকে। শোনা যায়, অর্থবছরের শেষদিকে এসে কোম্পানিগুলো তাদের ঘাটতি মেটাতে গ্রাহকদের ওপর অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিল চাপিয়ে দেয়। হয়রানির আশঙ্কায় অনেক গ্রাহক এ নিয়ে আপত্তি করার সাহস দেখান না। ফলে ভুতুড়ে বাড়তি বিদ্যুৎ বিল করে ওই কোম্পানিগুলো জনসাধারণের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়, যা বেআইনি। করোনা সংকটকালে এ প্রতারণা আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।
তারা বলেন, ভুতুড়ে বিল করার অভিযোগ বেড়েছে। একদিকে বছর বছর বিদুতের দাম বাড়ছে, আরেকদিকে নাগরিকরা ভুতুড়ে বিলের শিকার হচ্ছেন। তাহলে সেবাকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়িয়ে কী লাভ হলো সে প্রশ্ন করা জরুরি। এছাড়া, সরকারের সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে কাজ করা বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থাগুলো বাৎসরিক লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে গিয়ে ঘাটতি মেটাতে গ্রাহকদের ওপর বেশি বিল চাপিয়ে দেয় বলে যে অভিযোগ রয়েছে সে বিষয়েও তদন্ত হওয়া জরুরি।
তারা বলেন, বিদ্যুতের বাড়তি বিলের ভোগান্তি চলতে থাকলেও হয়রানির আশঙ্কা ও প্রতিকার না পাওয়ার হতাশা থেকে অনেক গ্রাহক আপত্তি করেন না। এই সুযোগে ভুতুড়ে বিল করেও বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয় গ্রাহকদের কাছ থেকে। জনস্বার্থে কাঠামোগত এই দুর্নীতির সুযোগ বন্ধ করার বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
তারা বলেন, স্বাভাবিক সময়ে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিলের সমস্যা সমাধানের জন্য গ্রাহকরা অফিসে ছোটাছুটি করতে পারেন। কিন্তু এই করোনা মহামারীর সময়ে এ ধরনের ছোটাছুটি ঝুঁকিপূর্ণ ও কঠিন। এই দুঃসময়ে দেশের জনসাধারণের সঙ্গে বিদ্যুৎ বিভাগের এমন কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই কাম্য নয়। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি- আপনারা বিষয়টির দ্রুত সমাধান করে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি নিরসন করুন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩৩০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ