আজ ১’লা মে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিপ্লবী নারীনেত্রী কল্পনা চাকমার ৪৫’তম জন্মদিন। ১৯৭৬ সালের আজকের এইদিনে রাঙ্গামাটি জেলার দুর্গম বাঘাইছড়ি উপজেলার নিউ লাল্যাঘোনা গ্রামের এক শ্রমঘনিষ্ঠ পরিবারে জন্ম হয় বিপ্লবী নারী নেত্রী কল্পনা চাকমার। পার্বত্য অঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রামে বেড়ে ওঠা “কল্পনা চাকমা” ছিলেন বেশ অন্তর্মূখী ও শান্ত স্বভাবের। শৈশব থেকেই চরম দারিদ্র, সামাজিক বৈষম্য, নারী পুরুষের ভেদাভেদ ও জাতিগত নীপিড়ন-নির্যাতন দেখে বড় হয়েছেন কল্পনা চাকমা। নিজেকে বোঝার সাথে সাথেই ছাত্রজীবন থেকে(এসএসসি পাশ করার পরে) যোগ দেন পার্বত্য চট্টগ্রামের লড়াকু নারী সংগঠন “হিল উইমেন্স ফেডারেশন”-এর সাথে। হিল উইমেন্স ফেডারেশনকে অন্যায় ও বৈষম্যর প্রতিবাদী মঞ্চ হিসেবে পেয়ে রপ্ত করলেন রূখে দাড়ানোর মন্ত্র। শৈশবে বাবা হারানো, চরম দুর্দিন, অভাব-অনটন ও মানবেতর জীবনের সাথে অনবরত লড়াই করে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে হয়েছিলো কল্পনা চাকমাকে। শত প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও নিজেকে হতাশ হতে দেয়নি। আগামীর অদম্য স্পৃহা নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়েছিলো সামনের সম্ভাবনায়। লিঙ্গ বৈষম্য, নারীর প্রতি ধর্মীয় অবজ্ঞা, জাতিগত নিপীড়ন-নির্যাতন এসব কখনো তার দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারেনি।
অন্যায়-অবিচার রূখে দাঁড়ানো ও প্রতিবাদের একমাত্র মঞ্চ হিসেবে পাওয়া হিল উইমেন্স ফেডারেশনের বিভিন্ন সাংগঠনিক সফরে পাহাড়ের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াতেন কল্পনা চাকমা। সাংগঠনিক কাজের যতটুকু ঝুঁকি ছিলো তার থেকে অধিক ঝুঁকি ছিলো তার পাহাড়কে চেনা-জানা এবং গভীরভাবে উপলব্ধি করার স্বার্থকতা অর্জন করা। তাই তিনি সংগঠনের সাংগঠনিক সফরের ক্ষেত্রে বেশ মনোযোগী ছিলেন। প্রত্যকটা সফরে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের দুর্বিসহ মানবেতর জীবন প্রণালীকে তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করতেন এবং তার প্রতিবাদী মন্ত্র দিয়ে নিপীড়ন আদিবাসীদের সংগ্রামী করে তুলতেন। কল্পনা চাকমা আস্তে আস্তে হয়ে ওঠেন পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের কাছে এক আদর্শিক বিপ্লবী বন্ধু। তার প্রগতিশীল ও আদর্শিক বিপ্লবী চিন্তাধারা গোটা আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী ও নারী সমাজের কাছে আগামীর শোষণ ও বৈষম্যহীন স্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।
বিপ্লবী নারী নেত্রী কল্পনা চাকমা ছিলেন “হিল উইমেন্স ফেডারেশনের” কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক। বিভিন্ন সাংগঠনিক সফরের তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি নিয়মিত ডায়রি লিখতেন। সেখানেই জমিয়ে রাখতেন নিজের মূল্যবান স্বপ্নের সম্ভাবনাময়ী অনুভূতিগুলো। গুণীজনের স্মরণীয় ও প্রেরণাদায়ক বক্তব্যগুলোও জমিয়ে রাখতেন কল্পনা তার ডায়রিতে। লিঙ্গ বৈষম্যসহ শৈশব থেকে দেখে আশা জাতিগত নিপীড়ন-নির্যাতন এবং রাষ্ট্রীয় অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে ইস্পাত প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন বিপ্লবী নারী নেত্রী কল্পনা চাকমা এবং এই কারণেই কল্পনা চাকমা পার্বত্য নারীদের কাছে হয়ে ওঠেন সংগ্রামী অনুপ্রেরণার মূখপাত্র। প্রতিবাদী হয়ে ওঠার কারণেই শোষক ও নিপীড়ক গোষ্ঠীর কাছে দ্রুত আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন কল্পনা চাকমা। আক্রমণের যথেষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হলেও কল্পনা চাকমা কখনো হতোদ্যম বা দমিয়ে যাননি। তিনি চলেছেন তার প্রগতিশীল আদর্শের বিপ্লবী স্বপ্নের অদম্য-অপ্রতিরোধ্য প্রতিবাদী গতিপথে।
কল্পনা চাকমা তার বিপ্লবী প্রগতিশীল আদর্শের চিন্তাধারায় গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে নিপীড়িত শ্রেণী ও জনমানুষের মুক্তি ছাড়া আলাদাভাবে নারী মুক্তি কখনো সম্ভব নয়। তাই তিনি জুম্মজাতির জাতীয় মুক্তির স্বপ্নে বিভোর থাকতেন তার সমস্ত চিন্তার বিকাশে। সকল জুম্ম নারীদের জাতীয় মুক্তির আন্দোলনে সামিল হওয়ার আহবান জানাতেন তার প্রতিটা বক্তব্যে।
কল্পনা চাকমা রাজনৈতিকভাবে কতটা সক্রিয় ও দৃঢ়চেতা ছিলেন, সহযোদ্ধাদের লেখা তার চিঠিতে তা ধরা পড়ে। সহযোদ্ধা রূপক চাকমাকে লেখা এক চিঠিতে কল্পনা লিখেছিলেন, ‘ভেবেছি, পরীক্ষায় পাস না করা পর্যন্ত সংগ্রাম স্থগিত রাখব, কিন্তু নেহাত অন্যায় আমার সামনে ঘটে যাচ্ছে কিছুতেই সহ্য করতে পারি নাই। প্রতিবাদ করতে হয়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে।’ আরেক সহযোদ্ধাকে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কী ভাবছি? উত্তরে আমি বলব, সেটা সময়েই জবাব দেবে। কেননা যেটা স্থির করা হয়, সময়ের প্রয়োজনে অনেক কিছু পরিবর্তন ঘটতে পারে।’ একটি প্রশ্নের জবাবে কল্পনা লিখেছিলেন, ‘অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আমি ভূমিকা রাখতে পারি কি না? যতদূর সম্ভব অবশ্যই থাকবে। অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ১ বছর যাবৎ আন্দোলন করে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছি এবং সবাইকে অগ্রণী ভূমিকা পালনের জন্যও জনসমাবেশের ডাক দিয়েছি।’ আন্দোলনে নারীদের ভূমিকার প্রশ্নে কল্পনার বক্তব্য ছিল, ‘পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের ভূমিকাও থাকতে হবে। বিশেষ করে নারী নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ ইত্যাদির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে এবং প্রত্যেককে স্বাবলম্বী হতে হবে।’ (কল্পনা চাকমার ডায়েরি, ২০০১)
কল্পনা চাকমার দৃষ্টিতে হিল উইমেন্স ফেডারেশন কেবল জাতিগত অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগঠন নয়। পুরুষ আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একটি পাঠশালা হিসেবেও দেখতেন তিনি হিল উইমেন্স ফেডারেশনকে। তার প্রগতিশীল চিন্তাধারার আরেক মূল বৈশিষ্ট্য হলো সমাজে পিছিয়ে পড়া নারীদের সামগ্রিকভাবে সচেতন করে তোলা।
কল্পনা চাকমার অদম্য অপ্রতিরোধ্য বিপ্লবী প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার স্পৃহা দেখে তথাসময়ের শাসক-শোষক শ্রেণীর মনে যথেষ্ট ভয়-ভীতির জন্ম হয়েছিলো। অর্থাৎ রাষ্ট্র খুব ভালো করে বিপ্লবী নারী নেত্রী কল্পনা চাকমাকে ভয় পেয়েছিলো। যার কারণে ১৯৯৬ সালের ১১’ই জুন রাতের আধারে নিজগ্রাম নিউ লাল্যাঘোনার বাড়ী থেকে বাঘাইছড়ি জোনের লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস-এর নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একদল সদস্য কতৃক পূর্বপরিকল্পিতভাবে কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়। বিভিন্ন প্রগতিশীল সংগঠনের পক্ষ থেকে কল্পনা চাকমা অপহরণের প্রতিবাদ করা হলেও রাষ্ট্র তাতে আমল দেয়নি। সঠিক তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের আইনের আওতায় এনে যথাযথ শাস্তি প্রদান করা হয়নি। কল্পনা চাকমার অপহরণকারীরা এখনো অবাদে ঘুরে বেড়ায় কিন্তু রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের আইন অপহরণকারীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে চরম ব্যর্থ। যা একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের জন্য অত্যন্ত লজ্জার বিষয়। অনতিবিলম্বে কল্পনা চাকমার অপহরণকারীদের আইনের আওতায় এনে যথাযথ শাস্তির জোর দাবি জানাই।
কল্পনা আজ নেই। রাষ্ট্রযন্ত্র ভেবেছিলো কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করে তার বিপ্লবী প্রগতিশীল আদর্শকে শেষ করে দেয়া যাবে! কিন্তু না। সেটা হয়নি। হয়েছে তার উল্টো। কল্পনা চাকমার অনুপস্থিতিতে আজ পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী নারীদের মননে হাজার কল্পনার জন্ম হয়েছে। কল্পনার অসমাপ্ত স্বপ্নের পথে হাটছে আদিবাসী হাজারো নারী কল্পনা চাকমার বিপ্লবী প্রগতিশীল আদর্শের পথ ধরে। কল্পনা চাকমার তেজস্বী আদর্শিক বিপ্লবী প্রগতিশীল চেতনা সঞ্চারিত হয়েছে আজকের আদিবাসী নারী সমাজে।
কল্পনা বেঁচে থাকবে অনন্ত কাল ধরে, জুম্মজাতির ঘরে ঘরে।
শুভ জন্মদিন প্রিয় নেত্রী। শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও বিপ্লবী লাল সেলাম।
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ