দখলের পর কুমিল্লা নগরীর পুরাতন গোমতী নদীর সম্পত্তিতে নির্মিত হয়েছে দোকানপাট ও বহুতল ভবন। নদীর বিভিন্ন অংশে স্যুয়ারেজ লাইন সংযুক্ত করা হয়েছে। প্রাকৃতিক এই জলাধারে ফেলা হচ্ছে ময়লা-আবর্জনা। নদীর পাড়ে গেলে মনে হয় সবাই যেন এটি দখল ও ভরাটের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এভাবে একের পর এক দখল, দূষণ ও ভরাটের কারণে নদীটি এখন প্রায় মৃত।
এদিকে গত কয়েক বছরে নদীর দুই পাড় দখল করে কাঁচা-পাকা অবৈধ স্থাপনা তৈরি করেছেন এমন ৫২২ ব্যক্তির তালিকা তৈরি করেছিল জেলা প্রশাসন। এই তালিকা তৈরি প্রথম শুরু হয়েছিল ২০০৩ সালে। ওই সময় থেকে দখলদারদের নদীর জায়গা ছেড়ে দিতে ১০ বারের বেশি নোটিশ দেয় প্রশাসন। এতেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। শুধু তালিকা তৈরি ও নোটিশ দেওয়াতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে নদীর সম্পত্তি উদ্ধার অভিযান।
জানা যায়, গোমতী নদী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উত্তর-পূর্ব পার্বত্য অঞ্চলের ডুমুর নামক স্থানে উৎপন্ন হয়েছে। নদীটি ত্রিপুরার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুমিল্লা বিবিরবাজার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এরপর নদীটি দাউদকান্দিতে গিয়ে মেঘনা নদীতে মিশেছে। বর্ষায় কানায় কানায় পূর্ণ থাকায় গত শতাব্দীর ষাটের দশকের আগ পর্যন্ত নদীটিকে কুমিলল্গার দুঃখও বলা হতো। তখন বর্ষার সময় নদীর পানিতে বন্যাও হতো। সে সময় কুমিল্লা নগরীকে বন্যার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য বাঁধ দিয়ে নদীর গতিপথ বদলে দেওয়া হয়েছিল। ওই সময় থেকে নদীর কুমিল্লা সদরের কাপ্তানবাজার থেকে চানপুর-শুভপুর পর্যন্ত অংশটুকুকে মানুষ পুরাতন গোমতী নামেই ডাকে। পুরাতন গোমতীর দৈর্ঘ্য প্রায় ছয় কিলোমিটার।
সরেজমিন পুরাতন গোমতীর চানপুর, ডুমুরিয়া চানপুর, শুভপুর, টিক্কারচর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নদীর বেশিরভাগ সম্পত্তিই অবৈধ দখলে। নদীর ওপর পাঁচটি স্থানে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে মানুষের চলাচলের জন্য রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। রাস্তার নিচে পানি চলাচলের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে ড্রেন। নদীর দুই পাড়ে নির্মিত হয়েছে বহুতল ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা। কোথাও কোথাও নদীতে আড়াআড়িভাবে দেওয়া বাঁধের দু’পাশে করা হয়েছে দোকান। দুই পাড়ের বেশিরভাগ মানুষ নদীর ভেতরেই ময়লা-আবর্জনা ফেলছে। নদীর পানি কালো ও দুর্গন্ধময়। এ পানিতে এখন কেউ নামে না। এ নদী সম্পর্কে বিস্তারিত না জানলে যে কারোরই মনে হবে এখানে খণ্ড খণ্ড কয়েকটি ডোবা। সব মিলিয়ে নদীটি এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।
সূত্র জানায়, পুরাতন গোমতী নদী থেকে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করার জন্য প্রশাসন পদক্ষেপ নিলেও রাজনৈতিক এবং বিভিন্ন কারণে তা এখনও আলোর মুখ দেখেনি। গত বছর হালনাগাদ তালিকা অনুযায়ী অভিযান চালিয়ে নদীর ২৫৮ দশমিক ৭৪ একর জায়গা অবৈধ দখলদারমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। পরে এ খবর পেয়ে দখলদাররা অভিযান ঠেকাতে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক তদবির শুরু করে। কাপ্তানবাজার, ভাটপাড়া, শুভপুর, চানপুর, সুজানগর, গাংচর, টিক্কারচর, মোগলটুলী শাহসুজা মসজিদ রোড, পুরাতন চৌধুরীপাড়া, বজ্রপুরসহ বিভিন্ন এলাকার মধ্যে পুরাতন গোমতীর দুই পাড়ের কয়েকশ একর সম্পত্তি অবৈধ দখলদারদের কবলে রয়েছে। দখলদারদের তালিকায় বেশিরভাগই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী। আছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরাও।
স্থানীয় বাসিন্দা ওমর ফারুক বলেন, সঠিক পরিকল্পনা নিলে পুরাতন গোমতী হয়ে উঠতে পারে কুমিল্লা নগরীর ফুসফুস। ২০১৭ সালে সিটি নির্বাচনের সময় বর্তমান মেয়র পুরাতন গোমতী নদীকে রাজধানীর হাতিরঝিলের মতো করার ইশতেহার দিয়েছিলেন। কিন্তু এখনও তিনি কাজের কাজ কিছুই করেননি। কুমিল্লার মানুষ মেয়রের এ ঘোষণার দ্রুত বাস্তবায়ন চায়।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিলল্গার সভাপতি ডা. মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, নদীটি রক্ষায় আমরা বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছি। জেলা প্রশাসক ও সিটি মেয়রকে স্মারকলিপি দিয়েছি। তবে দেশে আইন থাকলেও আইনের প্রয়োগ নেই, যার কারণে নদী দখলের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। নদীটি রক্ষা করতে হলে প্রশাসনকে অভিযানে যেতে হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল লতিফ বলেন, দখলকারীদের তালিকা তৈরি করেছি। সে তালিকা জেলা প্রশাসনকেও দেওয়া হয়েছে। আমাদের পর্যাপ্ত লোকবল নেই। তারপরও আশা করছি, দ্রুত সময়ের মধ্যে অভিযান চালিয়ে নদীর সম্পত্তি উদ্ধার করতে পারব।
এ প্রসঙ্গে কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মাঈন উদ্দিন বলেন, নদীর দুই পাড়ের অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে নিয়মিত অভিযান পরিচালিত হচ্ছে।
আপনার মতামত জানানঃ