ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও বৈষম্য বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০২৪ সালে ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতার অবনতি ঘটেছে। এর সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিবর্গ এবং গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার সুপারিশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম।
২০২৪ সালে ভারতে যেসব ঘটনা ঘটেছে তার ওপর বার্ষিক প্রতিবেদন ‘ইউনাইটেড স্টেটস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম-২০২৫’ প্রকাশ করা হয়েছে মঙ্গলবার। ৯৬ পৃষ্ঠার একটি রিপোর্টে ২৮ ও ২৯ নম্বর পৃষ্ঠায় ভারতের ওই বছরের বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের জুনে জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সদস্যরা ঘৃণামূলক প্রপাগান্ডা বা বক্তব্য ও ভুয়া তথ্য প্রচার করেছেন মুসলিম ও অন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে।
এর মধ্য দিয়ে তারা রাজনৈতিক ফায়দা নিতে চেয়েছেন। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার বিপরীতে গোষ্ঠীগত নীতি চাপিয়ে দিয়ে ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্র বানানোর চেষ্টা করেছেন তারা। এতে বলা হয়, ওইসব ঘটনার ফলে ব্যক্তিবিশেষ ও এনটিটিজ- যেমন বিকাশ যাদব ও গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’- এর বিরুদ্ধে তাদের টার্গেটেড নিষেধাজ্ঞা দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে মার্কিন সরকারের প্রতি। এসব অপরাধে জড়িত থাকার কারণে ওইসব ব্যক্তি বা সংস্থার যুক্তরাষ্ট্রে থাকা সম্পদ জব্দ অথবা তাদেরকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘনে অবদান রাখতে পারে বা তা আরও খারাপ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে এমন আশঙ্কায় ভারতের কাছে আর্মস এক্সপোর্ট কন্ট্রোল অ্যাক্টের অধীনে এমকিউ-৯বি ড্রোন বিক্রি করার বিষয় পুনর্মূল্যায়নের সুপারিশ করা হয়েছে সরকারের কাছে।
একইসঙ্গে ভারতে কংগ্রেসনাল প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং ধর্মীয় বিশ্বাসভিত্তিক নাগরিক সমাজের বিষয়ে আলোচনার জন্য অনুরোধ করা এবং অগ্রাধিকার দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রের এ রিপোর্ট দৃঢ়তার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছে ভারত। তারা যুক্তরাষ্ট্রের ওই প্যানেলকে ‘এনটিটি অব কনসার্ন’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এ রিপোর্ট পক্ষপাতী, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিজেপি’র উস্কানিমূলক বক্তব্য ও কর্মকাণ্ড ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাকে উৎসাহিত করেছে। নির্বাচনের পরেও তা অব্যাহত ছিল। এর মধ্যে আছে ভিজিল্যান্ট ভায়োলেন্স, টার্গেটেড এবং খেয়ালখুশি মতো হত্যাকাণ্ড, সম্পদ ও উপসনালয় গুঁড়িয়ে দেয়া। কর্তৃপক্ষ অব্যাহতভাবে সন্ত্রাসবিরোধী ও অর্থায়ন বিষয়ক আইনের সুবিধা নিয়ে নাগরিক সমাজের সংগঠনের বিরুদ্ধে দমনপীড়ন চালিয়েছে। এসব আইনের মধ্যে আছে ‘আনলফুল একটিভিটিজ প্রিভেনশন অ্যাক্ট’ (ইউএপিএ), ‘ফরেন কন্ট্রিবিউশন রেজুলেশন অ্যাক্ট’ (এফসিআরএ)। এসব ব্যবহার করে আটক করেছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের, ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে রিপোর্ট করার জন্য মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিকদের। নতুন আইন প্রণয়ন করে ফৌজদারি অপরাধের ধারা প্রতিস্থাপন করেছে সরকার। এর ফলে যদি মনে করা হয় সংখ্যালঘুরা দেশের সার্বভৌমত্ব, ঐক্য ও ভারতের অখণ্ডতাকে বিপন্ন করছেন, তাহলে সন্দেহজনকভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের টার্গেট করা যাবে। মার্চে ২০১৯ সালের সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট (সিএএ) বাস্তবায়নের নিয়ম সচল করে বিজেপি।
এর মধ্যদিয়ে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে অমুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ, যারা পালিয়ে ভারতে গিয়েছেন তাদেরকে নাগরিকত্ব দেয়ার কথা বলা হয়েছে। ২০১৯ সালে সিএএ’র বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করার জন্য ইউএপিএ’র অধীনে বেশ কিছু ব্যক্তিকে আটক রাখা হয়েছে। এর মধ্যে আছেন উমর খালিদ, মিরন হায়দার ও সারজিল ইমাম। জাতীয় নাগরিকপঞ্জিতে (এনআরসি) সব নাগরিককে তার নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে বলা হয়। এতে মুসলিমদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয় যে, তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হতে পারে। জুলাই মাসে আসামের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল ২৮ জন মুসলিমকে ‘নন-সিটিজেন’ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে বন্দিশিবিরে পাঠায়। সারা বছরে দিল্লি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (ডিডিএ)সহ বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ উপাসনালয়গুলোকে উচ্ছেদ ও ধ্বংসের সুযোগ করে দেয়। এর মধ্যে আছে মসজিদ ধ্বংস করে দেয়ার স্থানে মন্দির নির্মাণের অনুমতি। উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, জানুয়ারিতে অযোধ্যায় রাম মন্দির পবিত্রকরণে নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। ধ্বংস করে দেয়া বাবরি মসজিদের স্থানে দাঁড়িয়ে আছে এই মন্দির।
এর আগে ১৯৯২ সালে ওই মসজিদটি ভেঙে দেয় হিন্দু দাঙ্গাবাজরা। এই পবিত্রকরণের পরপরই ৬টি রাজ্যজুড়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে হামলা শুরু হয়। ভারতীয় দণ্ডবিধির ২৯৫ ধারা কর্র্তৃপক্ষ বার বার লঙ্ঘন করেছে। এই ধারায় কোনো উপাসনালয় ধ্বংস অথবা ক্ষতিগ্রস্ত করাকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। মসজিদসহ মুসলিম মালিকানাধীন সম্পত্তি গুঁড়িয়ে দেয়া বেআইনি। কর্তৃপক্ষ রাজ্যপর্যায়ে ধর্মান্তরবিরোধী আইন করে বৈষম্য করেছে এবং গরু জবাইবিরোধী আইন করে মুসলিমদের টার্গেট করেছে। জুন ও জুলাইয়ে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ ২০ জন খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ব্যক্তিকে আটক করে। এর মধ্যে চারজন পাদ্রি। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা রাজ্যের ধর্মান্তরকরণ বিরোধী আইন লঙ্ঘন করেছেন।
জুলাইয়ে উত্তর প্রদেশ রাজ্য সরকার একটি বিল আনে। এটা দিয়ে ওই আইনকে শক্তিশালী করার চেষ্টা হয়েছে, যাতে ধর্মান্তর করার শাস্তি হবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এর ফলে সন্দেহজনকভাবে আইন লঙ্ঘন করা কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে এফআইআর করার অনুমোদন থাকে। এই আইনে ধর্মান্তরকরণকে জামিন অযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। এরপর উত্তর প্রদেশের হাইকোর্ট মুসলিম ধর্মীয় নেতা কলিম সিদ্দিকী এবং অন্য ১১ জনকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণে অংশ নেয়ার অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।
উপরন্তু উত্তরাখণ্ড পাস করে ইউনিফরম সিভিল কোড (ইউসিসি) বিল। এতে আন্তঃধর্মীয় যুগলদের ক্ষেত্রে নিবন্ধন ও বৃহত্তর পুলিশি অনুমোদন দেয়ার কথা বলা হয়। ভারত সরকার দেশের বাইরেও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নিষ্পেষণমূলক কৌশল অব্যাহতভাবে ব্যবহার করে। বিশেষ করে শিখ সম্প্রদায় ও তাদের বিভিন্ন পরামর্শকের বিরুদ্ধে। সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলো ভারতের কন্সুল্যার সার্ভিস প্রত্যাখ্যানের রিপোর্ট করেন। আন্তর্জাতিক রিপোর্ট এবং কানাডা সরকারের গোয়েন্দা রিপোর্টকে একত্রিত করে অভিযোগ করা হয়, ভারতের রিসার্স অ্যান্ড এনালাইসিস উইংয়ের (র) একজন কর্মকর্তা এবং ৬ জন কূটনীতিক ২০২৩ সালে নিউ ইয়র্কে যুক্তরাষ্ট্রের একজন শিখ নেতাকে হত্যার চেষ্টা করেন।
ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ ভারত। এর জনসংখ্যা ১৪০ কোটির মতো। বেশির ভাগই হিন্দু (শতকরা ৭৯.৮ ভাগ)। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে আছেন মুসলিম (শতকরা ১৪.২ ভাগ), খ্রিস্টান (শতকরা ২.৩ ভাগ), শিখ (শতকরা ১.৭ ভাগ)। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধর্মীয় সংখ্যালঘুর মধ্যে আছেন বৌদ্ধ, জৈন, বাহাই, পারসি এবং ইহুদি। ভারতের সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদে সব মানুষের ধর্ম চর্চা, ধর্মীয় উপদেশ দেয়ার স্বাধীনতা দেয়া আছে। ২০১৪ সাল থেকে ভারতে সরকার চালাচ্ছে বিজেপি। তারা ২০২৪ সালের জুনে পুনর্নির্বাচিত হয়েছে। ১০ বছর ধরে ক্ষমতায় থেকে তারা ক্রমবর্ধমান হারে গোষ্ঠীগত পলিসি জোরপূর্বক চাপিয়ে দিচ্ছে। এর মধ্যদিয়ে তারা ভারতকে আপাদমস্তক একটি হিন্দু রাষ্ট্র বানাতে চায়।
পক্ষান্তরে সংবিধানের মূলমন্ত্র হলো ধর্মনিরপেক্ষতা। জুনের নির্বাচনের আগে সরকারি কর্মকর্তারা মুসলিম ও অন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক ও বৈষম্যমূলক বক্তব্য বিবৃতি দিতে থাকেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বার বার দাবি করতে থাকেন যে, বিরোধী দল (নির্বাচনে জিতলে) দেশ থেকে হিন্দুত্ববাদকে সমূলে উৎখাত করবে। একইসঙ্গে তিনি মুসলিমদেরকে ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ওদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও একইভাবে বিরোধীদলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন।
তিনি বলেন, যদি তারা বিজয়ী হন তাহলে দেশে শরীয়া আইন জারি করবেন। ওদিকে বিরোধীদের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে এমন কোনো কথার উল্লেখই ছিল না। সরকারি পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এ ধরনের ঘন ঘন মিথ্যা তথ্য ও উস্কানি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম হামলায় উদ্বুদ্ধ করেছে। উদাহরণ হিসেবে মিরা রোডে মুসলিমদের বিরুদ্ধে হামলার কথা তুলে ধরা হয়। বলা হয়, দু’জন এমএলএ নীতেশ রানা এবং গীতা জৈনের মধ্যে জ্বালাময়ী বক্তব্যের ফলে ওই ঘটনার উদ্ভব ঘটে।
আপনার মতামত জানানঃ